দেলোয়ারের পেটে ৫০০ কোটি!
শফিকুর রহমান : ডিএসসিসি মার্কেট সমূহের অবৈধ কর্মকান্ডের গডফাদার দেলোয়ার হোসেন এখন আঙ্গুল ফুলে বটগাছে পরিণত হয়েছে। কে তাকে ধরবে? মার্কেট সমূহের নিরীহ মালিকদের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই দেলোয়ার। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৮টি মার্কেটে ৩ হাজার ৮১টি অবৈধ দোকান গড়ে তুলেছে একটি প্রভাবশালী অসাধু চক্র। মালিক সমিতির নেতাদের সমন্বয়ে গত দুই দশকে গড়ে উঠে ওই চক্রটি।
সরেজমিনে জানা গেছে, প্রায় দু’দশক ধরে এসব দোকান তৈরি করে বিক্রি করা হয়েছে।প্রতিটি দোকানের ন্যূনতম গড়মূল্য ছিল অন্তত ১২/১৩/১৪ লাখ টাকা করে। সে হিসাবে দোকান বিক্রি করে ওই চক্রটি অন্তত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এতথ্য সংশ্লিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের।
ব্যবসায়ীরা জাতিরকন্ঠ কে জানায়, সিটি কর্পোরেশন সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে মার্কেটের মালিক সমিতির নেতাদের সমন্বয়ে গত দুই দশকে গড়ে উঠে ওই চক্রটি। এই চক্রের অন্যতম গডফাদার দেলোয়ার হোসেন। সে এখন আঙ্গুল ফুলে বটগাছ। যে কোন সময় দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারে দেলোয়ার।
প্রশাসনকে পকেটে নিয়ে দেলোয়ার প্রকাশ্যে ডিএসসিসির এসব মার্কেটের নকশা লঙ্ঘন করে অবৈধ দোকানপাট নির্মাণ করলেও নির্বিকার ছিল কর্তৃপক্ষ। এসব মার্কেটের অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করতে আগের কোনো মেয়র বা প্রশাসক কোনো উদ্যোগ নেননি। অভিযোগ তারাও মোটা অংকের টাকা বখরা নিয়েছে দেলোয়ার গংদের কাছ থেকে।
ডিএসসিসির বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের ঢাকা অধ্যুষিত ডিএসসিসিকে বদলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে এই প্রথম শুরি কররেন।
তার নির্দেশে ডিএসসিসির ৯৩টি মার্কেটের নকশাবহির্ভূত অবৈধ দোকান যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করে রাজস্ব বিভাগের মার্কেট শাখা। এর মধ্যে ২১টি মার্কেটে ৩ সহস্রাধিক অবৈধ দোকানের অবস্থান নিশ্চিত হয় মার্কেট শাখা। এর মধ্যে ৩টি মার্কেটের অন্তত শতাধিক অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করেছেন সংস্থার সম্পত্তি বিভাগের নেতৃত্বে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।
বর্তমানে ১৮টি মার্কেটের ৩ হাজার ৮১টি দোকান রয়েছে। ডিএসসিসি মেয়রের নির্দেশে রাজস্ব বিভাগ সেসব দোকান উচ্ছেদ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার দিনভর গুলিস্তান ডিএসসিসির নগরভবন সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট ২ মার্কেটে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ডিএসসিসি। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস জাতিরকন্ঠ কে বলেন, ডিএসসিসির অনেকগুলো মার্কেটে কয়েক হাজার অবৈধ দোকান রয়েছে। যেগুলো নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর এসব দোকানপাট অপসারণ কাজ শুরু করেছি। সব অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করা হবে।তিনি বলেন, কে কখন, কী উদ্দেশ্যে এসব অবৈধ দোকানপাট বরাদ্দ দিয়েছে-এখানে সেটা বিবেচ্য হবে না। এখানে মূল বিবেচ্য বিষয় নকশাবহির্ভূত দোকান ডিএসসিসি বরাদ্দ দেয়নি। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অনড়। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় সব মার্কেটের অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করা হবে। মার্কেটের মূল বরাদ্দ প্রাপকদের ব্যবসার পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়া হবে।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, নকশানুযায়ী নিউ সুপার দক্ষিণ মার্কেটের দোকান সংখ্যা ১ হাজার ২২৪টি। সংস্থার পক্ষ থেকে ওই দোকানগুলোই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সম্পত্তি বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ওই মার্কেটে নকশাবহির্ভূতভাবে ২০টি দোকান গড়ে বিক্রি করেছে অসাধু চক্র। এসব দোকান থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নিয়েছেন তারা।নিউ সুপার উত্তর ডি-ব্লক মার্কেটের নকশানুযায়ী দোকান সংখ্যা ৫২৭টি। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫২২টি। মামলার কারণে ৫টি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হয়নি। এ মার্কেটেও সম্পত্তি বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহায়তায় ৪১টি দোকান গড়ে বিক্রি করেছে অসাধু চক্র। চকবাজার পাবলিক টয়লেট নকশানুযায়ী মার্কেটের দোকান সংখ্যা ৩৬টি। এ মার্কেটে নকশাবহির্ভূতভাবে ১টি তৈরি করে বিক্রি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিউমার্কেট এলাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ সংলগ্ন দুই পাম্প স্টেশনের মাঝখানে নিজ খরচে সেমিপাকা ঘর তুলে নেয়ার শর্তে ৮৪টি দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়। পরে সেখানে অবৈধভাবে তিন তলা মার্কেট নির্মাণ করে বরাদ্দকৃত দোকানের চেয়ে আয়তনে অনেক বড় দোকান তৈরি করা হয়েছে।
একইভাবে অবৈধভাবে ১১২টি দোকান তৈরি করে বিক্রি করেছে মার্কেট সমিতির নেতা এবং স্থানীয় পর্যায়ের সরকারদলীয় রাজনৈতিক দলের অসাধু নেতারা। সূত্রে আরও জানায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন মার্কেটে নকশাবহির্ভূত দোকান সংখ্যা ৯টি, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ (ব্লক-এ)-এ দোকান ৩০৮টি, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ (ব্লক-বি)-এ দোকান ২৯১টি, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ (ব্লক-সি)-এ দোকান সংখ্যা ৩১১টি, সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের দোকান ৬৬৯টি, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হকার্স মার্কেটে দোকান ২৫০টি, নর্থসাউথ রোড সাইড মার্কেটে ৪টি, পুরান ঢাকার নওয়াব ইউসুফ মার্কেট, ভবন-১, ২, ৩, ৪, ৫-এ দোকান ৩৬টি, নওয়াব ইউসুফ এক্সটেনশন মার্কেটের অবৈধ দোকান ৭টি।
এ ছাড়া কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্স ১ নম্বর ভবনের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৪৫১টি। এ মার্কেটের নকশানুযায়ী নির্মিত দোকানের সংখ্যা ৬৫৯টি। এর মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫৬২টি।মামলার কারণে ৯৭টি দোকান বরাদ্দ প্রক্রিয়া ঝুলে রয়েছে। কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্স ২ নম্বর ভবনের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৪৪৭টি। আর এ মার্কেটের নকশানুযায়ী নির্মিত দোকানের সংখ্যা ৪৬৬টি। এর মধ্যে ৫২টি মামলা জটিলতার কারণে বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হয়নি। আহসান মঞ্জিল সুপার মার্কেটের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৩৮টি।
অনুমোদন ছাড়া ভবনের ছাদে ৩২টি দোকান নির্মাণসহ মোট ৩৮টি দোকান গড়ে বিক্রি করেছে অসাধু চক্র। নকশানুযায়ী নির্মিত এ মার্কেটের মোট দোকান সংখ্যা ৯১৬টি। লক্ষ্মীবাজার মার্কেটের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৩৫টি এবং সূত্রাপুর কমিউনিটি সেন্টার মার্কেটের অবৈধ দোকান সংখ্যা ৪৭টি।
মার্কেটের দোকানী রাফসান আহমেদ জাতিরকন্ঠ কে বলেন, পনের লাখ টাকা দিয়ে অস্থায়ীভাবে আমি দোকান নিয়েছি। এখন কেন ভাঙচুর হবে।কাকে টাকা দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেলোয়ার ও তার সহযোগীরা টাকা নিয়েছে। মার্কেটের ব্যবসায়ী নেতারা আছেন, সিটি করপোরেশনের লোকজন আছে। আমি প্রায় সাত বছর আগে দোকান নিয়েছি।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মামুন বলেন, এই উচ্ছেদের বিষয়ে কিছু জানি না। কে বা কারা দোকান মালিকদের থেকে টাকা নিয়েছে, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি চার, পাঁচ মাস আগে দায়িত্ব পেয়েছি। মার্কেটের বিষয়ে আমি কোনো অভিযোগও পাইনি। আমি উচ্ছেদের পক্ষে না, আমি ব্যবসায়ীদের পক্ষে। তারা বৈধভাবে ব্যবসা করে খাক, এটা আমি চাই।