বিশেষ প্রতিবেদক.ঢাকা :
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের ক্ষমতার এখতিয়ার নিয়ে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কামাল হোসেন। নোটিশে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি কমিশনারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, তাঁরা চেয়ারম্যানের আইনবহির্ভূত কাজকে অবৈধভাবে সমর্থন দিচ্ছেন।
নোটিশে দুদক আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী কমিশনের কার্যক্রম পরিচালনার অনুরোধ জানানো হয়। তা না হলে ‘জনস্বার্থে’ মামলা করার কথাও উল্লেখ করা হয়।
আজ রোববার দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বরাবর পাঠানো এ নোটিশটি দুই কমিশনার, দুদক সচিব, দুদকের মহাপরিচালককে (প্রশাসন) পাঠানো হয়। এ ছাড়া অন্য পাঁচজন মহাপরিচালককে অবগতির জন্য নোটিশের অনুলিপি দিয়েছেন এই আইনজীবী।
নোটিশ পাওয়ার কথা স্বীকার করে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, ‘এটাকে গুরুত্ব সহকারে দেখছি না। নোটিশের কোথাও আমাকে জবাব দিতেও বলা হয়নি। তার পরও বিষয়টি নিয়ে দুদকের আইন শাখার সঙ্গে কথা বলব। ’
কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আজ এ-সংক্রান্ত নোটিশ পেয়েছি, পর্যালোচনা করে দেখছি।’
নোটিশে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, কমিশনের অন্য সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। এতে করে দুদক আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। এ ছাড়া দুদক আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে এ আইনি নোটিশে।
নোটিশে দুদক আইন ও বিধির বিভিন্ন ধারার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের এখতিয়ার সমান হলেও চেয়ারম্যান এককভাবে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। দুদক আইনের ১৫(১) ধারায় ‘কমিশনের সিদ্ধান্ত’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘কমিশনের সকল সিদ্ধান্ত উহার সভায় গৃহীত হইতে হইবে।’
‘সকল সিদ্ধান্ত’ বলতে অনুসন্ধান, মামলা, তদন্ত অনুমোদন, চার্জশিট, ফাইনাল রিপোর্ট, প্রশাসনিক কার্যক্রম, আর্থিক বিষয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও বিভাগীয় ব্যবস্থাকেও বোঝায়। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, মামলার অনুমোদন ছাড়া সব সিদ্ধান্তই চেয়ারম্যান এককভাবে গ্রহণ করছেন। পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেষে কমিশনারদের কাছে অবহিতকরণের জন্য একটি চিঠি দেওয়া হয়। যা আইনের ১৫ ধারার পরিপন্থী।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, চেয়ারম্যান কমিশনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই বেআইনিভাবে প্রধান কার্যালয়সহ আন্তজেলা বদলি, পদায়ন এমনকি বিভাগীয় শৃঙ্খলাজনিত শাস্তিমূলক মামলাগুলো কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই প্রদান করেছেন।
কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও ক্ষমতা বিষয়ে দুদক আইন ও বিধির বিভিন্ন ধারার কথা তুলে ধরা হয় নোটিশে। এতে বলা হয়, দুদক আইন ২০০৪ এর ৫(১) ধারা অনুযায়ী ‘কমিশন তিনজন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত হইবে এবং তাহাদের মধ্য হইতে রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করিবেন।’ রাষ্ট্রপতি কমিশনারদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করলেও কমিশনের সংজ্ঞায় চেয়ারম্যানকেও একজন কমিশনার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, দুদক আইনের ২(খ) ধারা অনুযায়ী ‘কমিশনার’ অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো কমিশনার। এ অনুযায়ী চেয়ারম্যানও একজন কমিশনার। আইনের ১৪ ধারায় ‘কমিশন সভা’ সম্পর্কে চেয়ারম্যানকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আইনের ১৪(১), ১৪(২) এবং ১৪(৩) ধারায় বিধানাবলি সাপেক্ষে সভার কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ, সভা আহ্বান, সভার স্থান ও সময় নির্ধারণ এবং সভায় সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব চেয়ারম্যানের।
নোটিশে অভিযোগ করে বলা হয়, বিধান অনুযায়ী কমিশন স্বাধীন হলেও দুই কমিশনারকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে ‘প্রধান নির্বাহীর’ কাছে। পদাধিকার বলে দুদকের প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন ‘চেয়ারম্যান’। ফলে দুই কমিশনার স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। অথচ ‘কমিশনার’ হিসেবে তিনজনেরই (চেয়ারম্যান ও অন্য দুই কমিশনার) কাজের এখতিয়ার সমান।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়, আইনের ১২(১) ধারায় চেয়ারম্যানকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, কমিশন আইনে চেয়ারম্যানকে কমিশনের সভায় সভাপতিত্ব ও সময় স্থান নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মাত্র (ধারা ১৪-এর ২ ও ৩)। আবার ১৬ (২) ধারার বিধানে সুস্পষ্টভাবে কমিশনের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে।
এ বিষয়টি উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়, এসব বিধান সমন্বয় করলে চেয়ারম্যানের সভার সভাপতিত্ব ছাড়া অন্য কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
আইনের ১৪(৪) ধারার কথা উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়, এ ধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যানসহ দুজন কমিশনারের উপস্থিতিতে সভার কোরাম গঠিত হতে পারে। ফলে কোরাম হওয়া মাত্র কমিশনের এক সদস্যকে বাদ দিয়েই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে যাবতীয় কার্যক্রম শেষে বিষয়টি উত্থাপিত হচ্ছে কমিশন সভায়। অথচ ‘স্বাধীন কমিশনের’ ধারণা অনুযায়ী, যেকোনো বিষয়ে কার্যক্রম শুরুর আগেই দুই কমিশনার অবহিত এবং অনুমোদন দেওয়ার আবশ্যকতা থাকার কথা।
নোটিশে আরও বলা হয়েছে, দুদক বিধিমালা ২০০৭ অনুযায়ী প্রয়োজন হলে কমিশন সরকারের কাছে কোনো কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাকে প্রেষণে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করতে পারবে। তবে কমিশন আইনের কোথাও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা উল্লেখ না থাকলেও অতীতে দুদকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ছিল এখনো আছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি উল্লেখ করে নোটিশে বলা হয়েছে—‘এ বিষয়ে কমিশনকে জবাবদিহি করার সুযোগ রয়েছে।’