দুদকের কব্জায় রাঘববোয়াল-দুইবার জবাইয়ের অভিযোগ
বিশেষ প্রতিনিধি : রাঘববোয়ালদের ধরা শুরু করেছে দুদক। এর’ই পর্যায়ে পারটেক্স গ্রুপের মালিক আবুল হাসেমের পুত্র রাসেল ও সাবেক রাজউক চেয়ারম্যান ইকবালউদ্দিনকে পাকরাও করা হয়েছে। আজ তাদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
আদালত জানায়, প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির এক মামলায় পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ হাসেমের ছেলে শওকত আজিজ রাসেল ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবালউদ্দিন চৌধুরীর জামিন নাকচ করে তাদের কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশন মতিঝিল থানার এ মামলায় রাসেলকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়েছিল; ওই আবেদনও আদালত নাকচ করে দিয়েছে। মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদার বৃহস্পতিবার শুনানি করে এই আদেশ দেন বলে দুদকের আইনজীবী মাহামুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন।
বিচারক আদেশে বলেছেন, আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে যে কোনো দুই দিন তদন্ত কর্মকর্তা কারা ফটকে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। পারটেক্স থেকে ভাগ হয়ে গঠিত আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেল ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবি) ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালকের দায়িত্বে আছেন।
রাসেলের ভাই সিটি ব্যাংকের পরিচালক আশফাক আজিজ রুবেলও দুদকের দায়ের করা এ মামলার আসামি, যিনি পারটেক্স গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আছেন।রাসেল, রুবেল, ইকবালউদ্দিনসহ আটজনকে আসামি করে বুধবার মতিঝিল থানায় একটি মামলা করেন দুদকের উপ সহকারী পরিচালক সিলভিয়া ফেরদৌস। ইকবালউদ্দিন চৌধুরী এক সময় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন।
ইকবালউদ্দিন চৌধুরী রাজউকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে ও অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে’ অন্য আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে দুই ভাই রাসেল ও রুবেলকে ২০ কাঠা জমির দুটি প্লট বরাদ্দ দেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার পরীবাগের বাসা থেকে ইকবালউদ্দিন এবং গুলশানের বাসা থেকে রাসেলকে গ্রেপ্তার করেন দুদক কর্মকর্তারা।
দুপুরে তাদের ঢাকার আদালতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে চেয়ে আবেদন করে দুদক। রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের কৌঁসুলি মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, এই আসামির রাজধানীতে একাধিক বাড়ি থাকা সত্ত্বেও প্লট নেই বলে পূর্বাচল প্রজেক্টে প্লট বরাদ্দ চেয়ে রাজউকের কাছে আবেদন করেন তিনি, যা অবৈধ।
পরে যদিও ওই আবেদন প্রত্যাহার করা হয় এবং জামানতও ফেরত নেন তিনি। কিন্তু কারা সব জেনে শুনেও তাকে প্লট বরাদ্দ দিয়েছিল, তাদের নাম-ঠিকানা জানার জন্য তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি।
হাসেমপুত্র রাসেলের পক্ষে আইনজীবী মিজানুর রহমান রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করে বলেন, এই প্লটের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন এর আগে মামলা করেছে। ওই মামলা ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। একই অপরাধে এক ব্যক্তিকে দুই বার বিচারের মুখোমুখি করা অবৈধ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০৩ ধারা ও সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। আমরা কি দুই বার জবাই হব?
এই আইনজীবী আরও বলেন, দেশের অর্থনীতির চাকা যারা ঘোরান, সে সব দু-চারজনের মধ্যে ইনি (রাসেল) একজন। এসব লোককে যদি এভাবে ধরে এনে হেনস্থা করা হয়। তবে আমাদের দেশের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে।
রাসেলের আরেক আইনজীবী মঞ্জু মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ টিপু বলেন, অভিযুক্ত হাই কোর্টের একজন আইনজীবী। তার স্ত্রীও একজন আইনজীবী। অভিযুক্ত ইউসিবিএল ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ইবাইস ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান, শেখ জামাল ক্লাবের চেয়ারম্যান। তিনি মারাত্মক অসুস্থ। হৃদযন্ত্রে তার রিং পরানো রয়েছে। রিমান্ডে গেলে তিনি ফেরত নাও আসতে পারেন।
রাসেলের স্ত্রী আইনজীবী ফারাহনাজ চৌধুরীও স্বামীর রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক সত্যব্রত শিকদার জামিন ও রিমান্ড উভয় আবেদন নাকচ করে রাসেলকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন। রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল উদ্দিনের পক্ষে জামিন চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের নেতা কাজী নজিবুল্লাহ হিরু।
দুই আসামির পক্ষে কারাগারে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা, চিকিৎসার আবেদন করা হলে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন বিচারক। মামলার বাকি পাঁচ আসামি এসডি ফয়েজ, একেএম ওয়াহেদুল ইসলাম, এস এম জাফরুল্লাহ, এইচএম জহিরুল হক ও রেজাউল করিম তরফদার এক সময় রাজউক বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
দুদকের উপ পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জাতিরকন্ঠকে জানান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ইকবালউদ্দিন চৌধুরী ২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত সময়ে রাজউকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৮টি সরকারি ভবন বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে অর্থ আত্মসাতের এক মামলায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ইকবালউদ্দিনকে কারাগারেও যেতে হয়েছিল। শওকত আজিজ রাসেলের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলাও হয়েছে এর আগে।
গুলশান ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত আজিজ রাসেলের বিরুদ্ধে এর আগে কর ফাঁকির অভিযোগে মামলা করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। রাসেলের বাবা এম এ হাসেমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও ওই মামলার আসামি।
নোয়াখালী-২ (বেগমগঞ্জ-সোনাইমুড়ী) আসনের সাবেক সাংসদ হাসেমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জবরদখল, কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন সময়ে মামলা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, যার অনেকগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি এখনও।
তামাক দিয়ে ব্যবসা শুরু করা হাসেম গত পাঁচ দশকে তার বাণিজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন ভূমি উন্নয়ন ও আবাসন, আমদানি-রপ্তানি, পার্টিকেল বোর্ড, ইস্পাত, প্লাস্টিক, ভোগ্যপণ্য, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন খাতে। বিএনপির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের শুরুতে।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং সাংসদ নির্বাচিত হন। ওই সরকারের মেয়াদ শেষে রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। আরও অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদের মত গ্রেপ্তার হন হাসেম। সে সময়সন্দেহভাজন দুর্নীতিগ্রস্তদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে হাসেমের নামও ছিল।
পরের বছর জামিনে মুক্তির পর থেকে গত প্রায় আট বছর রাজনীতিতে একপ্রকার নিষ্ক্রিয়ই ছিলেন এই ব্যবসায়ী। গত ডিসেম্বরে তিনি বিএনপি মহাসচিবকে চিঠি পাঠিয়ে পদত্যাগের কথা জানান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যেও পরিবর্তন এনেছেন হাসেম। পারটেক্স গ্রুপ ও পারটেক্স স্টার গ্রুপ থেকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আম্বার গ্রুপ।
এসব গ্রুপের অধীনে রয়েছে ৬০টির বেশি কোম্পানি, যেগুলোর দায়িত্ব হাসেম দিয়েছেন ছেলেদের হাতে। হাসেমের স্ত্রী সুলতানা হাসেম ও পুত্রবধূরাও এসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে আছেন।
সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, জনতা ইন্স্যুরেন্স ও আইডিএলসি ফাইন্যান্সের মালিকানার অংশ রয়েছে হাসেম পরিবারের হাতে।
হাসেমের পাঁচ ছেলের মধ্যে সবার বড় আজিজ আল কায়সার টিটো বেশ কিছু দিন সিঙ্গাপুরে ছিলেন। পারটেক্স স্টার গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। দ্বিতীয় ছেলে আজিজ আল মাহমুদ মিঠু পারটেক্স স্টার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আইডিএলসি ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান।
পারটেক্স গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির দেখভাল করছেন হাসেমের দুই ছেলে আজিজ আল মাসুদ ও আশফাক আজিজ রুবেল। আর শওকত আজিজ রাসেল দেখছেন আম্বার গ্রুপ।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে রাসেলের সঙ্গে তার বাবা এম এ হাসেমও আছেন। আর সিটি ব্যাংক লিমিটেডের পর্ষদে আছেন কায়সার, তার স্ত্রী তাবাসসুম কায়সার, রুবেল ও তার স্ত্রী সৈয়দা শিরিন আজিজ এবং মাহমুদের স্ত্রী সাবেরা এইচ মাহমুদ।
মাসুদের স্ত্রী জি উন লি একজন বিদেশি নাগরিক। আর রাসেলের স্ত্রী ফারাহনাজ চৌধুরী আম্বার গ্রুপ ছাড়াও জনতা ইনসুরেন্সের পরিচালক।