দিন-দুনিয়ার মালিক খোদা-তোমার দিল কি দয়া হয় না-পবন দাস বাউল
উদাস বাউল: ‘দিন-দুনিয়ার মালিক খোদা-তোমার দিল কি দয়া হয় না-কাঁটার আঘাত দাও গো যারে- ফুলের আঘাত সহে না… নানা প্রান্তের শ্রোতার প্রিয় এক শিল্পী পবন দাস বাউল। আজ শুরু হওয়া ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক ফোক ফেস্টিভ্যাল ২০১৫’র অন্যতম আকর্ষণ প্যারিস প্রবাসী ৫৬ বছর বয়সী ভারতীয় এই খ্যাতিমান লোকশিল্পী। ‘দিল কি দয়া হয় না’, ‘নাচো গো কালী’, ‘বসুন্ধরার বুকে’, ‘মনের মানুষ’, ‘আমার চোখ কোনো এক পাখি’, ‘গোপন প্রেমের কথা’সহ তার বেশ ক’টি শ্রোতানন্দিত গান নিয়ে তিনি আগামীকাল সন্ধ্যায় উৎসব মঞ্চে উঠবেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের গান, দর্শন, অভিজ্ঞতাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। পবন দাসের মতে, দেশভেদে লোকসঙ্গীতের আত্মা এক। লোকগান পরম্পরার গান; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে থাকে রক্তকণিকায়।
বাউল জীবন কেন?
মনে বাউলিয়ানা ভর করলে কেউ কি বাউল না হয়ে পারে! পারে না। আমার বাউল হওয়ার পেছনেও এ কথা প্রযোজ্য। বাবার সঙ্গে মাধুকরি অর্থাৎ গানের বিনিময়ে ভিক্ষে করতে করতেই আমার মনে বাউলিয়ানা ভর করে। যদিও আমার বাবা দিবাকর দাস জাত বাউল ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের মোহাম্মাদপুর গ্রামের এক কৃষক। কৃষিকাজ করলেও সঙ্গীতের নেশায় আসক্ত ছিলেন তিনি। বিভিন্ন উৎসবে তিনি কীর্তন গাইতেন। আমার ৬ বছর বয়সে হঠাৎ একদিন বাবা অসুস্থ পড়েন। তার চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করতে হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সংসারে অনটন বাড়তে থাকে। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষায় বের হন। বাবা গাইতেন আর আমি দোহারি করে নাচতাম। গান শুনে লোকেরা দু’পয়সা দিত। তা দিয়ে আমাদের সাতজনের অন্ন জুটে যেত। এভাবেই হাটে-বাজারে, পথে-প্রান্তরে, ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করেছি। এভাবে চলতে চলতে অসংখ্য ফকির আর সাধুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের জীবন প্রণালী আমাকে আকৃষ্ট করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাউল জীবনের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। এর পর সময় ক্ষয়ে ক্ষয়ে বাউল বনে গেছি।
বাউল জীবনের দর্শন কী?
আমি পড়াশোনার সুযোগ পাইনি। বাবার কাছে বাল্যশিক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ কেবল পড়েছি। জ্ঞান-বুদ্ধির যেটুকু প্রসার ঘটেছে তা ফকির-সন্ন্যাসীর সঙ্গ পাওয়ায়। সে কারণে দর্শনের মতো গভীর বিষয়ে কথা বলা আমাকে মানায় না। বাউল জীবন বলতে আমি কেবল এটা বুঝি_ ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবান যাই বলি না কেন, তিনি কোনো উপাসনালয়ে থাকেন না; থাকেন আত্মার গভীরে। দিনমান তাই নিজের মাঝে তার অনুসন্ধান করতে হয়। বাউলরা গানে গানে সেই অনুসন্ধান চালিয়ে যান। আমিও সেই আত্মানুসন্ধানে বাউল জীবন বয়ে চলছি।
এবার ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট ২০১৫’ কতটা ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে?
আন্তর্জাতিকভাবে লোকসঙ্গীত উৎসব আয়োজন নিঃসন্দেহে অনেক বড় বিষয়। এমন আয়োজনে অংশ নিতে পেরে সত্যিই আমি আনন্দিত। এর আগে ঢাকায় যেসব অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি, তার সঙ্গে বিস্তর তফাত রয়েছে। প্রথমবার তো ঢাকায় এসে গান করারই সুযোগ পাইনি। কী এক অজ্ঞাত কারণে আমার সঙ্গীত বাতিল করে দেওয়া হয়। পরেরবার যখন ঢাকায় আসি, তখন চারদিকে ছিল সুনামির হাহাকার। সে কারণে মনটা বিষাদে ছেয়ে গিয়েছিল। আনন্দ-উদ্দীপনা নিয়ে গান গাওয়ার ইচ্ছে কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে গিয়েছিল। এবার আগের অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটিয়ে মন-প্রাণ উজাড় করে গাইতে চাই। আরও চাই গানে গানে দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে বাউল গানের মাহাত্ম্য তুলে ধরতে।
লোকগানের শ্রোতা দিনের পর দিন বাড়ছে বলেই আমার ধারণা। নইলে আন্তর্জাতিকভাবে এত বড় উৎসবের আয়োজন করা হতো না। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখছি, তরুণরা ব্যান্ড গড়ার প্রতি বেশি আগ্রহী। শুরুর দিকে পপ, রক, মেটাল নিয়ে তারা নানা রকম আয়োজন করত। এখন অনেকেই ফোক গান করছে। কয়েকটি ব্যান্ডকে আমার গানও পাশ্চাত্য ঘরানার সঙ্গীতের সঙ্গে গাইতে দেখেছি। তার পরও কোনো প্রশ্ন করিনি_ কেন তারা হঠাৎ ফোক গান গাওয়া শুরু করেছে? কারণ, উত্তরটা আমার জানা। আমি খুব ভালোভাবেই জানি, ফোক বা মাটির গানের আবেদন হাজার বছরেও ম্লান হওয়ার নয়।
যুগের হাওয়ায় গা ভাসালেও শিকড়ের টানে নতুন প্রজন্মের শিল্পী ও সঙ্গীতায়োজকদের বারবার তাদের মাটির কাছেই ফিরে আসতে হবে। বাংলাদেশের এ উৎসব থেকেও নতুন প্রজন্মের অনেকেই শিকড়ের গানের প্রতি উৎসাহিত হবেন_ নিঃসন্দেহে। এই উৎসব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফোক শিল্পীদের মাঝে একটি বন্ধন তৈরি করে দেবে।
বাংলাদেশের লোকশিল্পীদের গান সম্পর্কে বলুন ?
আব্বাসউদ্দীন আহমদ, আবদুল আলীম, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মুজিব পরদেশীর গান আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাদের অনেক অ্যালবাম এখনও আমার সংগ্রহে আছে। সময় পেলে শুনি। নতুন স্বাদের গান করার অনুপ্রেরণা পাই।
বাংলাদেশের অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের সঙ্গে ফিউশন করেছেন। কীভাবে হলো এটি?
অর্ণবের সঙ্গে আগে থেকে আমার পরিচয় ছিল না। আমি কেবল বুনোকে চিনতাম। বাউল গানের প্রতি তার অসম্ভব ভালোবাসা আছে। সময়ের দাবি মেটাতে সে পাশ্চাত্য ঘরানার সঙ্গীতের সঙ্গে একাধিক লোকজ গান ফিউশন করেছে। সেগুলো আমার মতো অনেকের কাছেই চমকপ্রদ আয়োজন বলে মনে হয়েছে। বুনোর বন্ধু অর্ণব। তারা একসঙ্গে গান করে। সে কারণেই অর্ণব অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের সঙ্গে বাউল গানের ফিউশন করেছি। ভালো লেগেছে এই অভিজ্ঞতা। তারা মেধাবী।
ফিউশন সম্পর্কে বলুন?
ভিন্নধারার সঙ্গীতের মিশ্রণকে যে ফিউশন বলে সেটাই জানতাম না। এটি আমাকে জানিয়েছিলেন ব্রিটিশ মিউজিশিয়ান স্যাম মেলস। টানা ১২ বছর তিনি আমাকে বুঝিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই আমার সঙ্গে গান করবেন। কিন্তু আমি তো পুরোপুরি বাউল। আর তিনি ভিন্নধারার সঙ্গীতায়োজক; আমরা একসঙ্গে গান করব কীভাবে? এটাই ছিল আমার উদ্বেগ। এর পর আমাকে তিনি বুঝিয়েছেন কীভাবে ফিউশন গান তৈরি হয়। এর পর আমরা একসঙ্গে কাজ শুরু করি। ভিন্ন স্বাদের এই ফোক আয়োজন করতে গিয়ে মনে হয়েছে, ফিউশনটা একেবারে মন্দ নয়। এর পর ‘রিয়েল সুগার’ অ্যালবাম প্রকাশ করি। এর গানগুলো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ একটাই এতে বাউল গানের আদল ধরে রেখে পাশ্চাত্যের সঙ্গীতায়োজনে তা রেকর্ড করা হয়েছে। এটিও চমৎকার এক অভিজ্ঞতা।
স্যাম মেলস সম্পর্কে বলুন?
১৯৭৭ সালে ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জর্জ লুনো বাউলদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে ভারতে এসেছিলেন। গৌর ক্ষ্যাপা, রমানন্দ আর আমাকে নিয়ে ‘সং অব দ্য ম্যাড ম্যান’ [পাগলদের গান] শিরোনামের তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। সেটি ১৯৭৯ সালে ফ্রান্স জাতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচার হয়। এটি দেখেই আমাকে খুুঁজতে ভারতে এসেছিলেন স্যাম মেলস। তার পরে তো অনেক গল্প। কিছুটা তো বলেছি।
প্যারিস গেলেন কীভাবে?
ঘটনাটা কাকতালীয় বলা যায়। ‘পাগলদের গান’ তথ্যচিত্র দেখার পর ১৯৮১ সালে রেডিও ফ্রান্সের কর্মকর্তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানান। যার সুবাদে ৩০ বছর বয়সী আমি প্রথমবারের মতো প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা করি। ১৯৮২ সালে ফ্রান্সের সংস্কৃৃতি মন্ত্রণালয় পুনরায় আমন্ত্রণ জানায়। তার পর থেকেই কলকাতা-প্যারিস নিয়মিত যাতায়াত করেছি। এখন তো প্যারিসেই সময়টা বেশি কাটে আমার।
আপনার কাছে জীবনের সংজ্ঞা কী?
আমার কাছে জীবন মানে অন্তহীন এক ভ্রমণ। আমার ভ্রমণের সঙ্গী বাউল গান। সামান্য সময়ের জন্য এসেছি পৃথিবীতে; চলেও যাব যে কোনো সময়_ এই সত্য আমার মন থেকে কখনও হারায় না। তাই নিজেকে, ঈশ্বরকে, সত্যকে খুঁজে ফিরি গানে। আমি খুব লেখাপড়া জানা মানুষ নই; পথই আমাকে শিখিয়েছে। মানুষ দেখে, মানুষের কাছ থেকে শিখি। আরও সহজ করে বললে মানুষই আমার কাছে জীবন।