দাবদাহে কাহিল শিক্ষার্থীরা-দুশ্চিন্তায় অভিভাবক
লাবণ্য চৌধুরী : গরমে একদিকে শিক্ষার্থীরা কাহিল অন্যদিকে মহা দুশ্চিন্তায় অভিভাবকেরা। এমনিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ফ্যানের সমস্যা তার ওপর তীব্র দাবদাহে বেহাল অবস্থা দেখা দিয়েছে শনিবার স্কুল খোলা রাখা নিয়ে। অনেক অভিভাবক বলেছেন, তাপপ্রবাহ একটু কমলে এই শনিবারের ছুটি বাতিল করলে ভালো হতো।
কিন্তু সরকার সেদিকে পা না বাড়ায়নি। ফলে তীব্র গরমে দুশ্চচিন্তায় পড়ছেন অভিভাবকরা। রবিবার দেশজুড়ে তাপপ্রবাহের মধ্যেই খুলেছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ। রোজা, ঈদ, পহেলা বৈশাখ এবং গরম মিলিয়ে লম্বা ছুটি শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুখরিত হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের পদচারণায়।
রোববার সকালে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের গেইটে দেখা যায়, অভিভাবকরা তাদের সন্তান পৌঁছে দিচ্ছেন; সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছেন পানি ও জুস। অনেকে বাচ্চাদের সঙ্গে ছাতাও দিয়ে দিয়েছেন। মগবাজার বিটিসিএল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মিস আসমা খন্দকার দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানালেন, বাচ্চারা যাতে রোদের মধ্যে বাইরে খেলাধুলা না করে, নিয়ম করে যাতে পানি খায় সেই পরামর্শ তিনি দিয়েছেন ।
অনেক অভিভাবক এই তীব্র গরমের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে ছিলেন না। তাদের শঙ্কা, বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে গরমের মেধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। আর শিক্ষকরা বলছেন, গরমে শিশুদের অস্থিরতা ধরা পড়ছে ক্লাস রুমে।
ঢাকার মিরপুরের শহীদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসিনা খাতুন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, “শিশুরা অস্থির হয়ে যাচ্ছে, কখন তারা বাসায় যাবে। বারবার পানি খেতে চাচ্ছে।
সময়সূচি এগিয়ে এনে রোববার সকাল ৮টা থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতেও আগের মত শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শহীদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শুভশ্রী দাস বললো, স্কুলে আসতে আসতে রোদে ঘেমে যেতে হয়েছে তাকে। তার ক্লাস শুরু হয়েছে পৌনে ১০ টায়।
তার ভাষ্য, অনেক রোদ ছিল। আমার বাসা ই ব্লকে। আসতে গিয়ে ঘেমে গেছি। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকলেও বাসায় ভালো লাগে না।সন্তানকে ক্লাসে পাঠিয়ে স্কুলের সামনেই অপেক্ষা করছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিফ হোসেনের মা ফরিদা ইয়াসমীন। তিনি বললেন, গরম ক্লাস শুরু হওয়ায় তিনি উদ্বিগ্ন।
আগে ক্লাসে দিয়ে চলে যেতাম। আবার নিতে আসতাম। আজ অপেক্ষা করছি। গরম তো অনেক। কি জানি কি হয়।এমন সময় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরতে হয়েছে, যখন দেশের অন্তত ৬৫ শতাংশ এলাকাজুড়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
শনিবার দেশের ৪২ জেলার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার তথ্য দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রোববার তাপপ্রবাহ আরও বেশি জায়গায় বিস্তার লাভ করতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদ শাহীনুল ইসলাম।
৩১ মার্চ থেকে দেশে তাপপ্রবাহ শুরু হয়। গত ২৮ দিন ধরে টানা তাপপ্রবাহ চলছে; যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে ঈদের ছুটির পর আর স্কুল খোলেনি সরকার। অসহনীয় গরমের কারণে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্কুল-কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
এই গরমে শিশুদের ‘অতি উচ্চ ঝুঁকির’ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বলেছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফও।তবে সাত দিন ক্লাস বন্ধ রাখার পর ছুটি আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে কারণে রোববার থেকেই ক্লাসে ফিরতে হল শিশুদের।
নতুন সূচিতে ক্লাসের সময় এগিয়ে আনার পাশাপাশি ব্যাপ্তিও কমানো হয়েছে। এক শিফটের স্কুলে ক্লাস চলবে সকাল ৮ থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। দুই শিফটে পরিচালিত স্কুলের প্রথম শিফট সকাল ৮ টা থেকে সকাল সাড়ে ৯টা এবং দ্বিতীয় শিফট পৌঁণে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলবে।
শহীদবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসিনা খাতুন ক্লাসে শিশুদের অস্থিরতার কথা বললেও ক্লাসের সময় কমানোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, আগে বাচ্চাদের তিন ঘন্টা ক্লাস হত। এখন দেড় ঘণ্টা হবে। এটা একটা ভালো দিক, তাদের স্কুলে কম সময় থাকতে হবে।
তবে অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন কমছে না। পল্লবীর লিটল ফ্লাওয়ার প্রিপারেটরি স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাতুল আহমেদের বাবা নাসিম আহমেদ মনে করেন, স্কুল খোলার বিষয়ে সরকার আরেকটু অপেক্ষা করলে পারত। ওরা তো খুব ছোট। স্কুলে যেতে-আসতে হচ্ছে। ক্লাসরুমগুলো একদম ছোট, সেখানে অনেক বাচ্চা গাদাগাদি করে বসে।
তিনি বলেন, শুক্র-শনিবার বাদ দিলে ক্লাস বন্ধ হয়েছে মাত্র ৫ দিন। এই বাচ্চারা তো রোজায় ছুটি কম পেয়েছে। এসব সমন্বয় করে তো আর ৪-৫ দিন দেখা যেত। কারণ কয়েকদিন পরই তো বৃষ্টি হয়ে গরম কমবে।
তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিফটের সময় কমিয়ে আনার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের বাইরে শ্রেণি কার্যক্রমের যে অংশ পরিচালিত হয়, সেসব কার্যক্রম সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছে। তাপপ্রবাহ সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত প্রাত্যহিক সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি) হবে না স্কুলে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে শিখনঘাটতি পূরণ এবং নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন ফল অর্জনের জন্য মাউশির অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শনিবারও শ্রেণি কার্যক্রম চলবে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শনিবারের ক্লাসের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ নিয়ে আপত্তি জানিয়ে পল্লবীর লিটল ফ্লাওয়ার প্রিপারেটরি স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক হাবিবুর রহমান বললেন, “কয়েকদিন ক্লাস বন্ধ থাকলে তো শিক্ষার্থীরা খুব বেশি পিছিয়ে পড়বে না। কিন্তু অসুস্থ হলে পিছিয়ে পড়বে। তবে লম্বা সময় তো ছুটি দিয়ে রাখাও গ্রহণযোগ্য হবে না। সে কারণে ছুটি নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে এখন শনিবারের ছুটি কোন যুক্তিতে বাতিল করলো? এ সিদ্ধান্ত কি গরম গেলে নেওয়া যেত না?”