তারা এখন বেহেস্তের হুরপরি পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন?
বিশেষ প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রোববার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।
মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে অনুষ্ঠিত একাদশ এশিয়া-ইউরোপ সম্মেলনের (আসেম) বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ঘণ্টাব্যাপী এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, গুলশান হামলার পর জঙ্গি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন অনেক রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এই ঐক্যের প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন কি না? উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। যারা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, যুদ্ধাপরাধ ও আগুন–সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত, তাদের কথা আলাদা। এদের বাইরে যাদের মধ্যে ঐক্য দরকার, যাদের সঙ্গে ঐক্য হলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে, তাদের মধ্যে ঐক্য হয়েছে।’
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে, তাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসলে উগ্রবাদ বন্ধ হবে না, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘তাদের (রাজনৈতিক দল) এই কথার অর্থ মনে হয়, তাদের সঙ্গে বসলে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস বন্ধ হবে, নইলে তারা তা চালিয়েই যাবে।’ গুলশান হামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একবার যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন এরা তো আর বসে থাকবে না। এখন আর এটা বাংলাদেশের একার সমস্যা না। এটা বিশ্বের সমস্যা।
শেখ হাসিনা বলেন, যে সম্মানজনক জায়গায় বাংলাদেশ আছে সেই জায়গায় গুলশানে হামলাকারীরা একটা ছেদ এনে দিল। এই ঘটনা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে সব সময় বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও দেশ সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে আসে, তা নয়। অনেক সময় দেখা যায়, একটা ঘটনা ঘটলে যেন তাদের উদ্দেশ্য সফল হলো।
এ ক্ষেত্রে দেশের মানুষের দায়িত্ব আছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গুলশানের ঘটনা ঘটার আগে গতবার ইতালির মিলানে আসেম সম্মেলনে গিয়ে গলা উঁচু করে কথা বলতে পেরেছি। অথচ আজকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও একই ঘটনা ঘটছে। পৃথিবীর অন্য জায়গায়ও একই ঘটনা। আমরা একই পর্যায়ে চলে গেছি।’
বাংলাদেশ নিয়ে আশঙ্কার কারণ আছে, না কি বিশ্বনেতারা বাংলাদেশ বলে উদ্বেগ দেখাচ্ছেন, এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কি একেবারে সত্যি কথা বলব। হয়তো অনেকের ভালো না লাগতে পারে। বাংলাদেশ নিয়ে যে প্রচার হচ্ছে সেটা আমাদের দেশ থেকেই বেশি হয়। বিশ্বনেতারা উদ্বেগ জানান। সম্প্রতি ফ্রান্স ও তুরস্কের ঘটনায় উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
বিশ্ব মিডিয়াতে বিভিন্ন হামলার ঘটনা সরাসরি দেখানো হয়, কিন্তু আমাদের দেশের মতো নয়। রক্ত, লাশ নয়। তারপর ঘটনা প্রতিরোধ করতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা-ও বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে। র্যাব-পুলিশ কী করছে, তা-ও দেখানো হচ্ছে। মিডিয়ায় বেশি প্রচার করার কারণে তারাও সেগুলো দেখায়। আমাদের মিডিয়ার তথ্য তারা দেখায়। তাহলে দোষটা কাদের দেব।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়ম অনুযায়ী চলবে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ কিছু নয়। একসময় মনে করা হতো দরিদ্র পরিবার ও মাদ্রাসার ছাত্ররা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে জড়িত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, উচ্চবিত্ত, ভালো খায়, ভালো পরে, ভালোভাবে চলে, যাদের জীবনের সব চাহিদাই পূর্ণ হচ্ছে, কোনো চাহিদা অপূর্ণ থাকছে না, সব পূর্ণ করার পর এখন তারা খুনখারাবি করছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা গুলি করছে, মানুষ মারছে তারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে।
তারা এখন বেহেশতে হুরপরি পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এটা কোন ধরনের অদ্ভুত চিন্তা। এর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না।’ তিনি বলেন, ‘এখানে তারা কী করে আসল। কারা তাদের পেছন থেকে উসকাচ্ছে। তাদের সাইকোলজিটা কী। তারা কেন এই পথে। এটা করলে নাকি বেহেশতের দরজা খুলে যাবে। মানুষ খুন করলে বেহেশতের দরজা খোলে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের সবাইকে মিলে জঙ্গি হামলা প্রতিরোধ করতে হবে। যে ধরনের সহায়তা দরকার, সেই ধরনের সহায়তা দিয়ে এক দেশ আরেক দেশকে সহযোগিতা করতে হবে। বাংলাদেশ তথ্যবিনিময়কে গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকেও বলেছি, বাংলাদেশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে। কেননা, তাদের প্রযুক্তি ভালো। অস্ত্র কারা দিচ্ছে, কারা তৈরি করছে, ডিলার কে, কারা কিনছে, অর্থদাতা কে এসব তথ্য দিয়ে এক দেশকে আরেক দেশের সহায়তা করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জঙ্গিদের নাম নিয়ে পুলিশকে দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। জঙ্গি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম নেয়। ঝিনাইদহে জঙ্গিরা অন্য নামে ছিল। এখানে নামটা মুখ্য নয়। ছবি প্রকাশের পর নাম পাওয়া গেছে। মূল বিষয় হলো, তদন্ত ঠিক করে হচ্ছে কি না। তিন জঙ্গির বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি না পাওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা দুঃখজনক। ২১ জন জঙ্গির বিচার হাইকোর্টে ঝুলে আছে।
বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও কাজ হচ্ছে না। এদের সাজা হলে অন্যরা বুঝত অপরাধ করলে সাজা পেতে হবে।’ তিনি বলেন, সব জায়গায় সব ধরনের লোক আছে। এদের কারণে সমস্যা হয়। আবার এদের তুলে ফেললে বলা হবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করা, গ্রাম পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি করা, জনমত গঠনে ধর্মীয় নেতাদের আহ্বান জানানো হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার তদন্ত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘটনা ঘটলে তদন্তের জন্য সময় দিতে হবে। আসেম সম্মেলন সম্পর্কে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের কঠোর অবস্থান তুলে ধরছেন। এর বিরুদ্ধে সব দেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে বলেও উল্লেখ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহ্রিয়ার আলম ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাহারা খাতুন উপস্থিত ছিলেন।