”ঢাকায় শিয়াদের ওপর হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট”
অনলাইন ডেস্ক: বাংলাদেশে ঢাকায় আশুরা উপলক্ষে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলার সময় বোমা হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট বলে খবর দিয়েছে সাইট নামে একটি ওয়েবভিত্তিক নজরদারি প্রতিষ্ঠান।
রয়টার্স সংবাদ সংস্থা জানাচ্ছে ইসলামী জঙ্গী কার্যকলাপের ওপর নজরদারি চালানো ওয়েবভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘সাইট’ ইসলামি স্টেটকে উদ্ধৃত করে বলেছে ”বাংলাদেশ খেলাফতের যোদ্ধারা” ঢাকায় তাদের ভাষায় ”বহু-ঈশ্বরবাদী আচার” পালনের সময় বিস্ফোরক হামলা চালিয়েছে।বোমা হামলায় ১৫ বছরের এক কিশোর নিহত হয়েছে।সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় ৫০ জনের মত মানুষের আহত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও বেশি মানুষ আহত হওয়ার খবর দেওয়া হয়েছে।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে তাদের হিসাবে আহতের সংখ্যা ৫০এর মত।ঢাকার হোসেনী দালান চত্বরে শুক্রবার দিবাগত রাত দু’টার দিকে এই হামলা ঘটে।
বাংলাদেশে এই প্রথম তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটলো।পুলিশ দুজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে জানিয়েছে।বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন যে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা জন্যে একটি ষড়যন্ত্র চলছে, তারই অংশ হিসেবে এই হামলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী মনে করেন যে এটি একটি “সন্ত্রাসী কাজ” এবং তিনি বলেন এই ঘটনার জন্যে দায়ীদের ছাড়া যাবে না।
’তাজিয়া কেড়ে নিলো আমাদের নয়নের মনিকে সাজ্জাদকে’
কান্না থামছে না কেরানীগঞ্জে চুনকুটিয়ায়। হাবিবনগর স্কুলের সামনে বহু মানুষের জটলা। সেখানেই ইমামবাড়ায় গ্রেনেড হামলায় নিহত সাজ্জাদের বাড়ি। সকালে নিহত সাজ্জাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় এলাকায়। এলাকাবাসির সবার আদরের ছিল সাজ্জাদ। তাই সবার চোখেই পানি। সবাই বলাবলি করছেন তাজিয়া কেড়ে নিয়েছে আমাদের নয়নের মনিকে সাজ্জাদ ওরফে সন্জুকে।
চোখে গাঢ় সুরমা, পুরো মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জরির চিহ্ন। জানাজার জন্য যখন খাটিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল মা রাশেদা ব্যাকুল হয়ে একে-ওকে বলছিলেন, ‘আমার সাঞ্জু আবার আসবে তো? না কি? আবার দিয়া যাবে তো?’
আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলে অংশ নিতে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে গতকাল শুক্রবার রাতে বাড়ি ছেড়েছিল সাজ্জাদ, আর আজ লাশ হয়ে ফিরেছে।
মো. নাসির আহম্মেদ আর রাশেদা বেগম দম্পতির পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট সাজ্জাদ। স্থানীয় চরাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সে। অন্য সন্তানেরা তেমন লেখাপড়া না করায় বাবা নাসিরের ইচ্ছে ছিল ছোট ছেলেকে ভালো করে পড়ালেখা করাবেন। সে জন্য তিনি বাবুবাজারে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কেরানীগঞ্জে এসেছেন। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। বাড়িতেও রেখেছিলেন গৃহশিক্ষক।
চুনকুটিয়ার মানুষ যখন সাজ্জাদকে এক নজর দেখতে ভিড় জমিয়েছে, তখন খানিকটা দূরে বসেছিলেন সাজ্জাদের বৃদ্ধ বাবা। বেলা যখন প্রায় দেড়টা তখন কেউ একজন হাত ধরে খাটিয়ার কাছে নিয়ে আসেন তাঁকে। ছেলের মুখ থেকে চোখ সরাতে পারছিলেন না নাসির। মনে মনে হয়তো ভাবছিলেন আদরের জাদুধনকে কীভাবে শেষ বিদায় জানাবেন।
এক সময় জটলার মধ্য থেকে আত্মীয়-স্বজনদের কাউকে বলতে শোনা গেল, যোহরের নামাজের পর জানাজা। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘মুর্দা’-কে তাড়াতাড়ি নিতে হবে। ব্যস্ত হাতে কাফনের কাপড়ে মুখ ঢেকে দেওয়া হলো সাজ্জাদের। তারপর খাটিয়া তুলে নিলেন কাঁধে। ডুকরে কেঁদে উঠলেন নাসির। মা রাশেদা তখনো প্রলাপ বকছেন।
টিভিতে রাত থেকেই সাজ্জাদের মৃত্যুর খবর প্রচার করা হচ্ছিল। তবু বিষয়টি রাশেদার কাছে গোপন রাখা হয়। রাশেদাও স্বজনদের কথা বিশ্বাস করেছিলেন। কারণ আগে কখনো মিছিলে অংশ নিতে দালানের ভেতর ঢোকেনি সাজ্জাদ। ও সব সময় যুক্ত হয়েছে দালান থেকে বেরোনোর পর। রাশেদা বলেন, মহররমের তাজিয়ায় অংশ নেবে বলে বেশ কিছুদিন ধরেই সাজ্জাদ প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চোখে সুরমা দিচ্ছিল রোজ, ইস্তিরি করে রেখেছিল কালো পায়জামা-পাঞ্জাবি।
কাল রাতের বোমা হামলায় এই পরিবারের আরও তিনজন আহত হয়েছেন। বোমার আঘাতে সাজ্জাদের ভাবি সুমির পায়ে জখম হয়েছে। সাজ্জাদের ভাগনির পেটে স্প্লিন্টার ঢুকেছে। পুড়ে গেছে শরীরে বিভিন্ন জায়গা। সাজ্জাদের খালা আয়েশা বেগমের অবস্থা আরও খারাপ। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সাজ্জাদের ভাবি সুমি কে বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও তাঁরা মহররমের তাজিয়ায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর স্বামী, দুই সন্তান, মা ও দেবর সাজ্জাদ একসঙ্গে মিছিলের সামনের দিকেই ছিলেন। প্রথমে যখন বোমার শব্দ পান , তাঁরা ভেবেছিলেন ট্রান্সফরমার পুড়েছে।
সেই শব্দের রেশ না মেলাতেই মুহুর্মুহু হামলা। একটি বোমা সাজ্জাদের পিঠের ওপর পড়ে। এতে সে উপুড় হয়ে পথের ওপর পড়ে গেলে শত শত মানুষ প্রাণ বাঁচাতে তাকে মাড়িয়ে চলে যায়। সুমি বলছিলেন, ‘আমার চোখের সামনে ও মারা গেছে। তখনই বুঝছি ও নাই। আমার পা গেছে। আমার মেয়ে স্নেহা চিৎকার করে কাঁদতেছে, ‘আম্মু, আমি মরে যাচ্ছি, আমাকে বাঁচাও।’ বেশ কিছুক্ষণ পর হোসনি দালানের লোকজন এসে তাঁদের হাসপাতালে পৌঁছে দেন।
সুমি যখন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, রাশেদা আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘কই কই ব্যথা পাইছে আমার সাঞ্জু? পিঠে ? পিঠে ব্যথা পাইলে কি মানুষ বাঁচে না? ব্যথা পাওয়ার পর কেউ ধরে নাই? সবাই ওর ওপর দিয়া গেছে?’