ডেটলাইন ৫ জানুয়ারি-ক্ষমতাসীন দলকে ডোবাচ্ছে যারা-
মজার ব্যাপার হলো, বিএনপির হয়তো খুব বেশি কিছু করতে হবে না। যেভাবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তাদের অন্যান্য দলীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি করছে, চাঁদাবাজি-দখলবাজি চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে হঠাৎ হাওয়া বদলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমান, কক্সবাজারের সাংসদ আবদুর রহমান বদি, টাঙ্গাইলের সাংসদ আমানুর রহমান খান ও তাঁর তিন ভাই মিলে খান ব্রাদার্স, লক্ষ্মীপুরের আবু তাহের, ফেনীর সাংসদ নিজাম হাজারী, গৌরীপুরের সাংসদ মজিবুর রহমান ফকিরের মতো কিছু নেতা-কর্মীই ক্ষমতাসীন দলকে ডোবাতে যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য মাঝেমধ্যে ওদের বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। সিলেটে ছাত্রলীগের দুই পক্ষকে সাবধান করেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা ছাড়া কাজ হবে না।
সাংসদ আবদুর রহমান বদিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি বুক ফুলিয়ে দুই আঙুলে বিজয়চিহ্ন দেখিয়ে হাসতে হাসতে জেলে গেলেন, আর দুদিন পরই হাসতে হাসতে গলায় ফুলের মালা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর এলাকায় বড় প্রতিবাদের আয়োজনও করা হয়েছিল! টাঙ্গাইলের খান ব্রাদার্সের সবাই নিজ দল আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমেদ হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়ার পর নাকি গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশ তাঁদের খুঁজে পায় না।
এক অর্থে পরিস্থিতি বিএনপির জন্য অনুকূল। কিন্তু হাল ধরার লোক নেই। মহানগর ও জেলায় নেতৃত্ব নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব দলকে দুর্বল করে রেখেছে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠন নিয়ে বিক্ষোভ এখনো চলছে। কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কেউ একটু মাথা তুলতে গেলেই মামলা। গ্রেপ্তার-জেলের ভয়ে সবার মুখ বন্ধ। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা দুটি আটকানো গেল না। হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট করে এখন পর্যন্ত কোনো লাভ হয়নি। মামলা চলবে।
ওদিকে যে তরুণ ও প্রভাবশালী নেতার বাংলাদেশের রাজনীতিতে এত দিনে সুনামি তোলার কথা, কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে তিনি লন্ডনে। চিকিৎসার জন্য তারেক রহমান সাত বছর ধরে সেখানে আছেন। কিন্তু লন্ডনে বসে তো বাংলাদেশের রাজনীতি চালানো কঠিন।
সুতরাং সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। আন্দোলন করবে কে? আমানউল্লাহ আমান ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্র কনভেনশনের যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন, অন্য সময় হলে সাড়া পড়ে যেত। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে নব্বইয়ের পটভূমি এখন নেই। আওয়ামী লীগ সরকার জোরজবরদস্তি করলেও ওরা তো এরশাদের মতো সামরিক সরকার নয়। গণ-অভ্যুত্থানে পতনের পর নব্বই-উত্তর রাজনীতিতে এরশাদের দল কখনো বিএনপি, কখনো আওয়ামী লীগের হুকুমের দাস হয়ে কাজ করছে। সুতরাং নব্বইয়ের সময়ের ছাত্রঐক্যের আদলে এখন কিছু করা যাবে না। ওই ওষুধে আর কাজ হবে না। আর তা ছাড়া, নব্বইয়ের ছাত্র কনভেনশনে যাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগ, জাসদ, বাসদসহ আরও অনেক দলই তো এখন সরকারে। সিপিবিরও নিজস্ব ধারা রয়েছে। ওরা সবাই এখন আমানের ডাকে সমবেত হবে, এ রকম ভাবার কোনো ভিত্তি নেই।
প্রকৃতপক্ষে ওই ছাত্র কনভেনশনে খালেদা জিয়ার আহ্বানে কিছু একটা ঘটে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। আর তা ছাড়া, সরকারও বসে থাকবে না। হয়তো নানা অজুহাতে সেই ছাত্র কনভেনশনই হতে দেবে না। আজকাল এ রকমই হচ্ছে। সরকার সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে পুলিশ লাগিয়ে দেয়। আন্দোলন ঠান্ডা করার এই অপকৌশল অবাধে চলছে।
তাই বিএনপি এবার একটু ঠান্ডা মাথায় চললেই ভালো। ৫ জানুয়ারি ডেটলাইন সামনে রেখে ‘শান্তিপূর্ণ’ সমাবেশ হোক। পূর্বঘোষিত কোনো এক দিন কয়েক মিনিটের জন্য সারা দেশে রাস্তায় হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ হতে পারে। ভালো কর্মসূচি। এতে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়বে। এসব দিয়ে শুরু করে শেষ পর্যন্ত দল ও জনগণকে মাঠের আন্দোলনে নামাতে পারলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
জামায়াতে ইসলামী এখন বেশ দুর্বল। ওদের মাঠে নামতেই দেওয়া হচ্ছে না। কিছু ইসলামপন্থী দল আছে। ওদের ওপর ভরসা করে কতটা আন্দোলন চালানো যাবে, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের চিন্তা-ভাবনায় সমস্যা আছে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি দলের নেতারা সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাঁদের শক্তভাবে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিতে বলেন। তখন তাঁরা জানতে চান, কোনো ‘সিগন্যাল’ আছে কি না (প্রথম আলো, ৮ ডিসেম্বর)। ওরা ‘সিগন্যালের’ ধান্দায় আছেন। ওই জটিল বিষয়ে না গিয়ে খালেদা জিয়া হেসে তাঁদের ‘আল্লাহর ওপর ভরসা করে’ আন্দোলনে নামার আহ্বান জানান।
বিরোধী দল দুর্বল হয়ে পড়েছে, আন্দোলনের শক্তি কমে গেছে, এসব কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের জন্য দুঃসংবাদ। সরকারি দলের নেতারা হয়তো বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না যে একচ্ছত্র ক্ষমতা দলের জন্য অভিশাপ। এতে দলের নেতা-কর্মীরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন, যার নমুনা বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। শুধু যশোরে গত ১১ মাসে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি-হানাহানি করে ১০ জন নেতা-কর্মীকে খুন করে ফেলেছে (প্রথম আলো, ৯ ডিসেম্বর)। এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন না হয়ে আওয়ামী লীগ সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিতে চাইছে। তারা বলছে, খুনোখুনি আওয়ামী লীগের লোকজন করছে না, অন্য দল থেকে লোকজন ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়ে নাকি অপকর্ম করছে। কিন্তু এসব লোকভোলানো কথায় কাজ হবে না।
বিএনপির নেতারা এখন বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেই নিজেদের অপকীর্তির ভারে ডুববে। এ রকম অনেক সময় হয়। তবে জনসম্পৃক্ত আন্দোলন ছাড়া কখনো হয় না। এখানে বিএনপিকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। ‘হটাও আন্দোলনের’ পুরোনো পথে গেলে বিএনপির জনসমর্থন হারানোর আশঙ্কা থাকবে।
এতে সন্দেহ নেই যে মূল বিরোধী দল বিএনপিকে বাইরে রেখে, শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হয়ে যে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে, সেটা তাদের গলার কাঁটা হয়ে আছে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটে নেই। এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আওয়ামী লীগকেই উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে তাদের বিপদ আসন্ন।
রাজনীতিতেও কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়। কখন কোন অছিলায় মানুষ রাস্তায় নেমে পড়বে, কেউ জানে না। আওয়ামী লীগের মতো গণতন্ত্রের চর্চায় পোড়–খাওয়া দল ৫ জানুয়ারি ডেটলাইনের তাৎপর্য বুঝে বিএনপির সঙ্গে যদি অর্থবহ সংলাপের দরজা খুলে দেয়, তাহলে সেটা হবে দেশে গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় সুসংবাদ।আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।quayum@gmail.com