স্টাফ রিপোর্টার.ঢাকা: ৪৮ ঘণ্টায়ও খোঁজ মেলেনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদের। তাঁর স্ত্রী হাসিনা আহমদের দাবি, ‘ডিবি’ পরিচয়দানকারী একদল অস্ত্রধারী মঙ্গলবার রাতে তাঁকে উত্তরা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। উত্তরার ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীও সালাহ উিদ্দনকে ধরে নেওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন।
তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কেউ সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে গেছে, নাকি তিনি নিজেই কোথাও গেছেন—এ বিষয়টি তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। পুলিশ বলছে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
সালাহ উদ্দিন আহমদকে কেন খুঁজে বের করা হবে না এবং ১৫ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁকে কেন আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এর আগে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ২১ ঘণ্টা পর তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে র্যাব। এই ২১ ঘণ্টা তিনি কোথায় ছিলেন, তা এখনো জানা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা মান্নার ২১ ঘণ্টা অবস্থানের জায়গাটি সম্পর্কে ধারণা দিলেও স্পষ্ট করে কোনো তথ্য দেননি।
সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী জানান, মঙ্গলবার রাতে উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের একটি বাসা থেকে সালাহ উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যান ডিবি পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা। এরপর বুধবার তিনি গুলশান থানায় জিডি করতে গেলে থানা থেকে বলা হয়, ‘যেহেতু ঘটনা উত্তরায়, তাই উত্তরা থানায় যেতে হবে।’
হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘এরপর উত্তরা পশ্চিম থানায় গেলে তারা বলল, আমি নাকি একটা ভাসমান খবর নিয়ে এসেছি। আমি বললাম, বাসার লোকজন দেখেছে তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে। পুলিশ বলে, বাসার মালিককে নিয়ে আসেন, আরও সাক্ষী নিয়ে আসেন। আমি একটা জিডিই তো করতে গিয়েছি, অন্য কিছু নয়।’স্বজনেরা জানান, উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের তিনতলা একটি বাড়ির দোতলায় আত্মগোপনে ছিলেন সালাহ উদ্দিন।
ওই বাসার নিরাপত্তাকর্মী আখতারুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার রাত সোয়া নয়টার দিকে বেশ কয়েকটি গাড়ি নিয়ে একদল লোক ওই বাসার সামনে আসেন। বাসার সামনে তিনটি গাড়ি ছিল। কিছুক্ষণ পর রাত ১০টা নাগাদ তাঁরা এসে বলেন, ‘আমরা ডিবির লোক। কোনো সমস্যা নেই।’ পকেট গেট খোলা ছিল। তাঁরা কয়েকজন সেই গেট দিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়লে আখতারুল জিজ্ঞেস করেন, ‘কী কারণে আসছেন?’ তাঁরা বলেন, ‘পরে জানতে পারবি।’
আখতারুল বলেন, এ সময় দুজন তাঁকে ‘চটকনা’ দেন। তাঁদের কাছে পিস্তল দেখে ভয় পান আখতারুল। তাঁরা নিজেদের ডিবির লোক বলে পরিচয় দেন এবং আখতারুলকে ‘চুপ করে বইসা থাক’ বলে কয়েকজন দোতলায় চলে যান।
আখতারুল বলেন, ‘সেখানে মনে হয় বুয়া দরজা খুলে দিছিল। লোকগুলা এরপর ২০-২৫ মিনিট ছিল। নামার সময় চোখ বাঁধা অবস্থায় দুজন দুই পাশে ধরে তাঁরে (সালাহ উদ্দিনকে) নিয়ে নামছে।’ পরে একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে চলে যান অস্ত্রধারীরা।
আখতারুল জানান, আটকের চার দিন আগে ওই বাসার দোতলার ভাড়াটে মেহমান হিসেবে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে আসেন। তাঁকে রেখে বাসার লোকজন চলে যান। পুলিশ সালাহ উদ্দিনকে নিয়ে যাওয়ার পর ওই বাড়ির গৃহকর্মীও আর আসেননি।
পাশের আরেকটি বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী বলেন, রাত সোয়া নয়টার দিকে চারজন লোক এসে তাঁর কাছে একটি বাসার নম্বর জানতে চান। এরপর তিনি বাসাটি দেখিয়ে দেন। চারজনের মধ্যে দুজনের কাছে অস্ত্র ছিল। তাঁদের দেখে মনে হয়েছে পুলিশ-র্যাবের কেউ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘তাঁকে আমরা গ্রেপ্তার করিনি।’
গতকাল মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজে এক অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, সালাহ উদ্দিন আহমেদের নিখোঁজের ঘটনা তাঁদের কাছে পরিষ্কার নয়। তিনি কোথাও গেছেন বা তাঁকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে কি না, এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।
হাইকোর্টের রুল: সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাইকোর্টে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে তাঁর স্ত্রী হাসিনা আহমেদ গতকাল ফৌজদারি কার্যবিধিতে একটি আবেদন করেন। আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও মওদুদ আহমদ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রুল দেন। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাবের মহাপরিচালক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ আট বিবাদীকে রোববারের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। শুনানিকালে আদালত বলেন, যেকোনো নিখোঁজ নাগরিককে খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের বা সরকারের দায়িত্ব।
পরে মওদুদ আহমদ বলেন, তাঁকে কেন খুঁজে বের করা হবে না এবং আদালতে হাজির করা হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, এটা সাধারণ একজন লোকের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপার নয়। উনি বহুদিন ধরে অন্তরালে থেকে অজ্ঞাত স্থান থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে হরতাল বা অবরোধের কর্মসূচি দিয়ে আসছেন। এখন এটা খুব চিন্তার বিষয়, ওনাকে সত্যিই কেউ অপহরণ করল, নাকি উনি নিজেই আত্মগোপন করে আছেন সরকারকে বিব্রত করার জন্য।
সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ‘অক্ষত’ অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে গতকাল বিকেলে সুপ্রিম কোর্টে ল রিপোর্টার্স ফোরামের কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এভাবে তুলে নিয়ে যাবে, কেউ কিছু বলবে না, এটা কীভাবে হয়?’
খালেদা জিয়ার উদ্বেগ: বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে গত মঙ্গলবার রাতের আঁধারে দরজা ভেঙে, চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরিয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় উদ্বেগ, ক্ষোভ ও তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খানের সই করা বিবৃতিতে খালেদা জিয়া বলেন, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ সারা দেশে শত শত নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারের পর অস্বীকারের উদ্বেগজনক প্রবণতা এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা এর দায় এড়াতে পারে না।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেপ্তারের পর থেকে সালাহ উদ্দিন আহমেদ দলের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
তিনি গ্রেপ্তার এড়িয়ে দল-জোটের পক্ষ থেকে বক্তব্য-বিবৃতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করে আসছিলেন। এতে ক্ষমতাসীনেরা যে তাঁর ওপর প্রচণ্ডÿক্ষুব্ধ ছিল, তা তাদের শীর্ষপর্যায় থেকে ব্যক্ত ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়াতেই স্পষ্ট হয়েছে।
এদিকে সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে ১৫ মার্চ কক্সবাজার জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে স্থানীয় বিএনপি।