• মঙ্গলবার , ১৯ নভেম্বর ২০২৪

ডিজিটাল চোর লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকে


প্রকাশিত: ১০:২৯ পিএম, ২১ মার্চ ১৬ , সোমবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪২ বার

বিশেষ প্রতিবেদক  :  সিআইডির তদন্তে মিলছে ডিজিটাল চোর লুকিয়ে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকে-। এই চোরচক্রকে ধরতে সিআইডি আলামত সংগ্রহ 1অব্যাহত রেখেছে।যদিও নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা গোপনে সমঝোতা করতে চেয়েছিল ফিলিপাইন। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঘটনাটির সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করা হলে তদন্তসাপেক্ষে খোয়া যাওয়া অর্থের পুরোটাই ফেরত পাবে বাংলাদেশ। কেননা এ ধরনের কেলেঙ্কারির কারণে দোষী দেশ আন্তর্জাতিকভাবে কালো তালিকায় পড়ার বিধান রয়েছে।

এ জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে একটি লিখিত প্রস্তাবও পাঠিয়েছিলেন ১৭ ফেব্রুয়ারি। তবে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার আগে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকেই ফিলিপাইন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আমান্দো তাতাঙ্কো ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম ও রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) বরাত দিয়ে একাধিকবার তা গোপন রাখার অনুরোধ করেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সে সময়ের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে তাতাঙ্কো এবং ফেডারেল রিজার্ভের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টেলিকনফারেন্সও করেন।

পরবর্তীতে তারা এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অ্যান্টি মানি লন্ডারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাউন্সিল (এএমএলসি) ও আন্তর্জাতিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্থার সঙ্গেও টেলিকনফারেন্স করেন। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম ও ফিলিপাইন এ ধরনের ঘটনাকে নন-পাবলিক ও হাই-কনফিডেন্সিয়াল বলে আখ্যায়িত করে তা সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষার অনুরোধ করে। সূত্র জানায়, ফিলিপাইনের গভর্নর চিঠিতে লেখেন, যেহেতু ৬ ফেব্রুয়ারির পরই ঘটনাটি সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জেনে যায়। ফলে পুরো ঘটনার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং সে অনুযায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হয়।

এক্ষেত্রে ১৭ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে তাতাঙ্কোর লেখা ওই চিঠিতে একটি উদাহরণও দেওয়া হয়, সর্বশেষ কয়েক বছর আগে পেন্টাগনে বড় অঙ্কের অর্থ চুরির ঘটনা ঘটে। যা ওই দেশের অর্থমন্ত্রীকে জানানো হয় ঘটনার তিন মাস পর এবং তদন্ত ও সমস্যা সমাধানের কাছাকাছি যাওয়ার আরও তিন মাস পর তা সে দেশের প্রেসিডেন্ট ও সংসদকে অবহিত করা হয়। এ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা না করলে আর্থিক খাতে মানুষের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। যা সে দেশের ব্যবসা-বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমন কি ভুক্তভোগী দেশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যায়।

সূত্র জানায়, ফিলিপাইন ও ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের এ ধরনের প্রস্তাব ও যুক্তি তাত্ক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন সদ্য পদত্যাগী গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর একাধিক উপদেষ্টাকেও জানানো হয়। তবে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা হয় ৬ ফেব্রুয়ারির পরই।

যার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে এবং গোপনীয়তা রক্ষায় সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককেও নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) এবং অ্যাগমন্ট গ্রুপের আইন ও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের খোয়া যাওয়া অর্থের পুরোটাই আরসিবিসির কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে বাংলাদেশকে ফেরতও দেওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছিল ফিলিপাইন ও ফেডারেল রিজার্ভ।

বাংলাদেশ ব্যাংকও মনে করে, এই অর্থ দীর্ঘ সময় পর হলেও ফেরত পাবে বাংলাদেশ। কেননা আন্তর্জাতিক অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি, দেশ বা প্রতিষ্ঠান ফেডারেল রিজার্ভকে ব্যবহার করে কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠান এক ডলার মানি লন্ডারিং করলে তার কাছ থেকে দ্বিগুণ হারে জরিমানা আদায় করা হবে। তবে সেটা তদন্ত এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

সূত্র জানায়, ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন থাকায় রবিবার সকালেই প্রধানমন্ত্রীকে রিজার্ভ চুরির ঘটনা অবহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর নির্দেশনা অনুযায়ী ৮ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা চায় বাংলাদেশ।

এ জন্য ঘটনার আদ্যোপান্ত ও আরসিবিসির লেনদেনের বিবরণসহ যাবতীয় তথ্যের অনুলিপি এএমএলসিতে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, আইন অনুযায়ী এ ঘটনার সমাধান যাই হোক, বাংলাদেশ তার খোয়া যাওয়া অর্থ ফেরত পাক আর না পাক, ফিলিপাইন মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় কালো তালিকায় পড়বেই।

এফবিআইয়ের সঙ্গে সিআইডির বৈঠক : যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনার তদন্তে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) প্রতিনিধিরা।

দুপুরে মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় পারস্পরিক তথ্য বিনিময় ও সহযোগিতা প্রসঙ্গে বৈঠকে কথা হয়েছে। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে শিগগিরই ফিলিপাইন যাচ্ছে সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি দল। তবে এ বিষয়ে আদালত ও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুপুর ২টার দিকে সিআইডি কার্যালয়ে প্রবেশ করেন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে অবস্থানরত এফবিআই প্রতিনিধি। সিআইডি কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলে এ বৈঠক। বৈঠক শেষে এফবিআই প্রতিনিধি গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা না বললেও সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) শাহ আলম বলেন, বেসিক্যালি দুটো বিষয় নিয়ে এফবিআইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে।

একটি হলো মানিটা যেখানে গিয়েছে সেই মানিটা ব্যাক করে আনা। এটা আমাদের একটা স্বার্থ। আর তাদের স্বার্থ হলো এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা। তিনি আরও বলেন, আলোচনায় টেকনিক্যাল ইস্যু নিয়েই বেশি কথা হয়েছে। এটা সম্ভব যে, আইটি ফরেনসিক এক্সপার্টদের স্কিল ব্যবহার করে, আইপি অ্যাড্রেস ব্যবহার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হ্যাকারের উৎসটাকে খুঁজে বের করা।

আরেকটা হচ্ছে মানি যেখানে পৌঁছেছে মানিটাকে রিভার্সলি ব্যাক করে আল্টিমেট বেনিফিসিয়ারি যারা আছে তাদের চিহ্নিত করা।
সিআইডির কর্মকর্তাদের ধারণা, হ্যাকার চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ না কেউ জড়িত রয়েছে। কিন্তু সে এমন সূক্ষ্মভাবে হ্যাকারদের সহযোগিতা করেছে যা সাধারণ উপায়ে বের করে আনা সময়ের ব্যাপার।

সিআইডি সূত্র জানায়, ফিলিপাইনে টাকা যাওয়া, সেখানকার রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের জুপিটার স্ট্রিট শাখার মাধ্যমে টাকা লুটকারীদের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা— এসবই পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ কারণে ফিলিপাইনের বেনিফিসিয়ারি চক্রটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে পুরো হ্যাকার চক্রটিকে শনাক্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ তাদের সহায়তা করেছে কিনা তা জানা যাবে। মূলত এ কারণেই সিআইডির একটি তদন্ত দল যত দ্রুত সম্ভব ফিলিপাইনে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম বলেন, এই ক্রাইমটা একাধিক দেশের লোকজনের মাধ্যমে হয়েছে। এ জন্য একাধিক দেশের ল-এনফোর্সারদের পারস্পরিক সহায়তাটা আমাদের লাগছে। আমরা ইন্টারপোলকে নিয়ে যেমন কাজ করছি তেমনি এফবিআইকে নিয়েও কাজ করছি। আমাদের প্রথম টার্গেট হলো যত দ্রুত সম্ভব ফিলিপাইনে গিয়ে আল্টিমেট বেনিফিসিয়ারিদের সঙ্গে কথা বলা বা জিজ্ঞাসাবাদ করা। এ জন্য সে দেশের আদালতেরও অনুমতি লাগবে। ঠিক তেমনি আমাদের দেশেরও সরকার ও আদালতের অনুমতি লাগবে। বিষয়টি অন প্রসেসিং রয়েছে।

সিআইডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিআইডির কর্মকর্তারা প্রত্যেক দিনই তথ্য সংগ্রহ করছে। বেশির ভাগ তথ্যই ডিজিটাল। যেহেতু ঘটনাটি পুরো ডিজিটাল চুরি বা হ্যাকিংয়ের ঘটনা হয়েছে এ জন্য সব তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি বিশ্লেষণের কাজও চলছে। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, তারা অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের ব্যাক অফিস অব দি ডিলিং রুম, ফরেন এক্সচেঞ্জ ও সিকিউরিটি সার্ভিলেন্স শাখা থেকে গতকাল পর্যন্ত কয়েক ট্যারাবাইট ডাটা সংগ্রহ করেছেন।

এখন পর্যন্ত ডাটা সংগ্রহ শেষ হয়নি। একই সঙ্গে সন্দেহভাজন কম্পিউটারগুলো জব্দ করে ফরেনসিক পরীক্ষা করা হচ্ছে। এসব কম্পিউটার থেকে কোনো ডাটা মুছে ফেলা হয়েছে কিনা বা অন্য কোথাও ট্রান্সফার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।শতাধিক কর্মকর্তাকে

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তারা এই কয়েক দিনে শতাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। যদিও সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এটিকে জিজ্ঞাসাবাদ না বলে মিটিং বা তথ্য সংগ্রহের জন্য আলোচনা বলে দাবি করছেন।সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজ ক্রাইম) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী বলেন, আমরা সন্দেহের পুরো বিষয়টি ধীরে ধীরে ছোট করে আনার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট করে কোন কম্পিউটারটি হ্যাকিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল তা জানার চেষ্টা করছি।