• শুক্রবার , ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ডিজিটাল চিটার র‌্যাপিড ক্যাশ- লুটেছে ৫’শ কোটি


প্রকাশিত: ৩:১৩ এএম, ১৮ মে ২৩ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪১ বার

বিশেষ প্রতিনিধি : অবশেষে অ্যাপস ‘র‌্যাপিড ক্যাশ’ এর ডিজিটাল চিটারি ধরে ফেলে গোয়েন্দারা। ভয়ংকর এই অ্যাপসটি ডাউনলোড করার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটির সম্পূর্ণ এক্সেস নিয়ে নেয় অ্যাপটি। যার মধ্যে রয়েছে ব্যবহারকারীর সমস্ত কন্টাক্ট নম্বর, গ্যালারি তথ্য ছবি, ভিডিও এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এরপর শুরু করে ডিজিটাল চিটারি। এরই ফাঁদে আটকে অটো ঋণের নামে প্রতারণার শিকার রাজশাহীর বোয়ালিয়া এলাকার আবুল ইহসান নামক এক ভুক্তভোগী
মামলা দায়ের করলে প্রশাসনের টনক নড়ে। বোয়ালিয়া থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলাও দায়ের করেন তিনি। সেটির তদন্ত করতে গিয়ে এটিইউ-সাইবার ক্রাইম উইংয়ের হাতে ধরা পড়ে ডিজিটাল চিটারের বাংলাদেশী চাঁই মহিউদ্দিন মাহি।

গোয়েন্দারা বলেছে, তিন বছরে অন্তত অর্ধকোটি গ্রাহককে অটো ঋণের ফাঁদে ফেলে কয়েক শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন অনুমোদন ছাড়াই। টাকার অংকে এদের চিটারি ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এই অ্যাপস র‌্যাপিড ক্যাশ’টির নিয়ন্ত্রণে থাকা চাইনিজ দুই নাগরিকের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। যারা বাংলাদেশে বসেই চায়না ভাষায় দক্ষ মহিউদ্দিন মাহির নামে এক বাংলাদেশির সহযোগিতায় উত্তরায় নামফলকহীন অফিস থেকে পরিচালনা করছিল ডিজিটাল চিটারি ব্যবসা র‌্যাপিড ক্যাশ।মাত্র ৫ টাকা সুদে ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে ঋণ দেওয়ার পরই আবেদন ফি ১২০ টাকা, ডাটা অ্যানালাইসিস ফি ১৮০ টাকা এবং ভ্যাট চার্জ হিসেবেও ১৫ টাকা কাটা হয় গ্রাহকেরই। যদিও ঋণ নেওয়ার আগে টাকা কাটার বিষয়ে কোনো তথ্য গ্রাহক জানতে পারে না বা জানানো হয় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সহজ শর্তে ঋণের কথা বলে অ্যাপস ইনস্টল করার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রাহকের মোবাইলের সব ধরনের তথ্য নিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর অল্প করে ঋণ দিয়ে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয় ৪০ থেকে শতগুণ টাকা। নির্ধারিত দিনে গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে বা আরও কিছুদিন টাকা দিতে না পারলে শতকরা হিসেবে বার্ষিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেয় র‌্যাপিড ক্যাশ। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সুদ হারের প্রায় সাড়ে ৫ গুণ বেশি। এছাড়া ভ্যাটসহ আবেদন প্রক্রিয়াকরণের নামে তারা যে ফি নিচ্ছে তা বৈধ কোনো ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান নেয় না। ঋণের টাকা পরিশোধ না করলে গ্রাহকের সব ডাটা, ছবি, ভিডিওসহ গোপনীয় তথ্যাদি ফাঁসের হুমকি দিয়ে ব্লাকমেইল করছে প্রতিষ্ঠানটি।

মঙ্গলবার(১৬ মে) রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানাধীন সোনারগাঁও জনপদ রোডের ছয় নাম্বার বাড়ি থেকে এ কাণ্ডের মূলহোতা মহিউদ্দিন মাহিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) সাইবার ক্রাইম উইং। এছাড়া এই ডিজিটাল ঋণ প্রতারণায় জড়িত দুই এজেন্টসহ আরও ২৫জনকে উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয়েছে।
আটকদের জিজ্ঞাসা ও প্রাথমিক তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির ১৫জন এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। যার মধ্যে পাঁচ এজেন্টের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে ঋণের চার কোটি টাকা আদায়ের তথ্য মিলেছে। আর বিট কয়েনে মহিউদ্দিন পাচার করেছেন আড়াই কোটি টাকা। বাংলাদেশে ব্যবহারযোগ্য যে কোন মোবাইল সিমের নম্বরের মাধ্যমে অ্যাপটি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হয়।

এক ভুক্তভোগী জানান, রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই র‍্যাপিড ক্যাশ ব্যবহারকারীকে অন্তত ৫০০/এক হাজার টাকা ঋণ প্রদান করে এবং ওই দিন হতেই ওই টাকার উপর প্রায় ৪০ থেকে একশ টাকা হারে সুদ আরোপ করে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই লোন পরিশোধের জন্য বা কমপক্ষে সুদের টাকা পরিশোধ করার জন্য র‍্যাপিড ক্যাশ তাদের হটলাইন নাম্বার (০১৯৫৬৭২৮৭৭৬ এবং অন্যান্য) এর মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন প্রদান করে। কোন গ্রাহক যদি এই উচ্চ হারের সুদ প্রদানে অস্বীকৃতি প্রদান করে তবে তাকে বিভিন্নভাবে প্রতারণা বা ব্ল্যাকমেল করা শুরু করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়- গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপনীয় তথ্যের জনসমক্ষে প্রকাশের হুমকি, ব্যবহারকারী নিজের সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে যখন ঋণ এবং সুদের টাকা প্রদানে সম্মতি প্রদান করে তখন র‍্যাপিড ক্যাশ থেকে নগদ বা বিকাশ এজেন্ট নাম্বার প্রদান করা হয়।

ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন সূত্রে জানা গেছে, র‌্যাপিড ক্যাশ অ্যাপস প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করতেই ৫ হাজার টাকার লোন অফার করে। একটু পর ৫ হাজার টাকার বদলে আসে ৩ হাজার টাকা। কিন্তু সুমিষ্ট ভাষায় কল সেন্টার থেকে নারী ফোন কণ্ঠে জানানো হয় ঋণের কথা। এক সপ্তাহের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে ৫ হাজারই। কিন্তু তা না পারায় প্রতিদিন হাজারে ৫০ টাকা করে চার্জ চেয়ে ফোন করা হয়। ভোগান্তি মনে করে অ্যাপসটি আনইন্সটল করলেও ঋণের ফাঁদ থেকে রক্ষা পাইনি। অটো ঋণের ফাঁদে টাকা পেয়েছি তিন হাজার। কিন্তু শোধ করতে হয়েছে সাত হাজার টাকা।তিনি বলেন, গুগলে রিপোর্ট করেছি, পুলিশে অভিযোগ করেছি। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। উল্টো আমি ভোগান্তিতে পড়েছি। আমাকে হয়রানি করা হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে অটো ঋণের টাকা আদায়ে বাধ্য করা হয়েছে। ঋণ না চেয়েও শুধু অ্যাপসটি ইন্সটল ও রেজিস্ট্রেশন করে প্রতারণার শিকার শাহরিয়ার তন্ময় নামক এক ভুক্তভোগী বলেন, সম্পূর্ণ অবৈধ ও প্রতারণামূলক একটি অ্যাপস র‌্যাপিড ক্যাশ। এটি রেজিস্ট্রেশন করে না চাইতেও ঋণ পাবেন। সেটি পাওয়ার পর শুধু আপনাকে ব্লাকমেইল করা। তিনবার অর্থ দিয়ে নিস্তার পেয়েছি।

এদিকে বুধবার(১৭ মে) দুপুরে রাজধানীর গুলশান-২ এর বারিধারা সোহরাওয়ার্দী অ্যাভিনিউস্থ এন্টি টেরোরিজম ইউনিট সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এটিইউ সাইবার ক্রাইম উইংয়ের পুলিশ সুপার ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, এই অ্যাপসটি চায়নায় ডেভলাপ করা। চাইনিজরাই জড়িত। চায়নায় পড়াশুনা করা মহিউদ্দিন মাহির নামক একজন ধূর্ত প্রতারক বাংলাদেশে এটি পরিচালনা করে আসছিল। তিনি বলেন, এটি শুধু বাংলাদেশে নয় ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানেও গ্রাহকদের সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা করে আসছিল। র‍্যাপিড ক্যাশ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ডিজিটাল লেনদেনে বৈধ প্রতিষ্ঠান নয় জানিয়ে তিনি বলেন, গুগলে অ্যাপসটি অ্যাভেইলেবল। এছাড়া ফেইসবুকেও বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। বাংলাদেশি গ্রাহকদের সঙ্গে লেনদেন করে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, রকেট ও নগদ এর মাধ্যমে।

তিনি আরও বলেন, আমরা দুই চাইনিজ নাগরিক সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি। তারা নাকি দেশ ছেড়েছেন। সেটি সত্য কিনা তা যাচাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি অ্যাপসটির ব্যবহার বন্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হবে। পাশাপাশি গুগল প্লে স্টোর থেকে যেন এমন প্রতারণামূলক অ্যাপস সরানো হয় সেজন্য অনুরোধ জানিয়ে গুগলকে মেইল করা হবে। এর প্রচার বন্ধে ফেসবুককেও জানানো হবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির ১৫জন এজেন্টের সন্ধান পেয়েছি। যার মধ্যে পাঁচ এজেন্টের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে চার কোটি ঋণের টাকা আদায়ের তথ্য মিলেছে। একেকটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার ঋণ আদায় করা হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো ঋণ আদায় হতো ১৫ অ্যাকাউন্টে। আরও অ্যাকাউন্ট আছে, সেগুলো আমরা খুঁজছি।তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর জালাল বলেন, পাঁচ এজেন্টের মধ্যে টঙ্গির সানাউল্লাহ ও বেলায়েত নামক নারায়ণগঞ্জের এজেন্টকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সানাউল্লাহ’র নগদ অ্যাকাউন্টে ৮০ লাখ ও বেলায়েতের নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে দেড় কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। তাদের ব্যবহৃত সিম অবৈধ। তারা নগদের এজেন্ট হলেও অবৈধভাবে র‌্যাপিড ক্যাশের অটো ঋণের কাজ করছিল।

র‍্যাপিড ক্যাশ নামক অ্যাপে ঋণ প্রতারণার বাংলাদেশি মূলহোতা মহিউদ্দিন মাহিরের বাড়ি ঢাকার রমনা থানাধীন শান্তিনগরের নিউ ইস্কাটনে। তার বাবার নাম গোলাম মোহাম্মদ। তিনি প্রভাতি উচ্চ বিদ্যা নিকেতন থেকে ২০১০ সালে এসএসসি ও বসুন্ধরা হামদর্দ পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর গ্রিন ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল ইন্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি শেষ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এক বছর মেয়াদি চায়না ভাষার উপরে কোর্স করেন। উত্তরার অফিসে কাজ করা তরুণ-তরুণীরা হিন্দি ও উর্দু ভাষায় ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ভারত ও পাকিস্তানে একই অ্যাপ ভিন্ন নামে লোন দিচ্ছে। একইভাবে তাদের সঙ্গেও ঋণ দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে এটিইউ সাইবার ক্রাইম উইংয়ের পুলিশ সুপার ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, চার বছরের স্কলারশিপ নিয়ে চীনে যান মহিউদ্দিন মাহির। সেখানেই চাইনিজ প্রতারক চক্রের মাধ্যমে র‌্যাপিড ক্যাশ অ্যাপস সম্পর্কে পরিচয় তার। ২০২০ কিংবা ২০২১ সালে ফিরে বাংলাদেশে অত্যন্ত গোপনে তিনি র‌্যাপিড ক্যাশ অ্যাপসে ঋণ প্রতারণা শুরু করেন।

এদিকে ক্রিপটো কারেন্সি বিট কয়েনে আড়াই কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে দাবি করে এসপি ফারহানা বলেন, আমরা যেসব ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করেছি সেখানে ক্রিপটো কারেন্সি বিট কয়েনে দুটি অ্যাকাউন্টের তথ্য পেয়েছি। যেখানে একটিতে দেড় কোটি ও আরেকটিতে ৮০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন। এসব টাকাই তিনি পাচার করেছেন। তার আরও অ্যাকাউন্ট আমরা খুঁজছি। এজন্য ফরেনসিক বিভাগের সহযোগিতা লাগবে।