• বৃহস্পতিবার , ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

টেনশন ২৮ অক্টোবর


প্রকাশিত: ১১:১২ পিএম, ২৩ অক্টোবর ২৩ , সোমবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭৯ বার

 

 

শফিক রহমান : নানা টেনশন ২৮ অক্টোবর নিয়ে নানা আশংকা রয়েছে। কারণ, ২০০৬ সালের এই ২৮ অক্টোবর বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের পতন রচনা হয়েছিল। বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণকে বাধা দিতে সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল।আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সারাদেশে লগি বৈঠা নিয়ে নেমে পড়েছিল। রাজধানীর পল্টন ছিল সেদিন রণক্ষেত্র।
একপর্যায়ে তৎকালীন বিএনপির রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।ওই দিন সারাদেশে আওয়ামী লীগ বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৮ জন নিহত হয়েছিল। সেই ঘটনার ১৭ বছর পর ফের একই দিনে বিএনপির মহাসমাবেশ ডাকার মধ্যে রয়েছে নানা টেনশন।

২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর এসেছিল ওয়ান ইলেভেন তথা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তৎকালীন সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদ তার ‘শান্তির স্বপ্নে: সময়ের স্মৃতিচারণ’ নামক বইতে সেই বর্ণনা করেছেন নিখুঁতভাবে।
মঈন ইউ আহমেদ বলেন, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সাথে বৈঠকে কিভাবে জরুরী অবস্থা জারীর বিষয়টি উঠে এসেছিল।

সে বইতে মঈন ইউ আহমেদ বর্ণনা করেন, ” আমি প্রেসিডেন্টকে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি, নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের আল্টিমেটাম এবং বিদেশী রাষ্ট্র সমূহের অবস্থান, বিশেষ করে নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানালাম। জাতিসংঘ মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হলে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে তা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সচেষ্ট হলো।”সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী।

২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশে যে ধরনের সহিংস পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে সে বিষয়টি গোয়েন্দা দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে বুঝিয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় সামরিক কর্মকর্তারা জরুরী অবস্থান জারীর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেন। দেশে জরুরী অবস্থা জারী করা হতে পারে – এমন ধারণা পেলেও বিষয়টি নিয়ে ১১ই জানুয়ারি সারাদিনই নিশ্চিত হতে পারছিল না আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র নেতারা।

সেদিন দুপুরে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে বৈঠক হয়েছিল আওয়ামীলীগ নেতাদের।সে বৈঠকটি হয়েছিল ঢাকাস্থ কানাডীয় হাই কমিশনারের বাসায়।
সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের পাশাপাশি আমেরিকার রাষ্ট্রদূত এবং ভারতের হাই কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সে বৈঠকের বর্ণনা দিতে গিয়ে মি: সেলিম বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ” বিভিন্ন কথার এক পর্যায়ে তারা বললো এভাবে হলে তো দেশ চলতে পারে না। এভাবে হলে তো বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা বাড়বে। আপনার দুই দল যদি সমঝোতায় না আসেন তাহলে অন্যরকম ঘটনা ঘটতে পারে। ওনাদের কথায় মনে হলো কী যেন একটা হচ্ছে। কারণ ওনারা পজিটিভ কিছু বললেন না।”

একদিকে রাস্তায় আওয়ামীলীগের আন্দোলন এবং অন্যদিকে বঙ্গভবনে সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা চলছে।
একই সাথে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ঢাকাস্থ বিদেশী কূটনীতিকরা। পর্দার অন্তরালে কী ঘটতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে অনেকটা অন্ধকারে ছিল সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়া দল বিএনপি। দলটি তখন ২২শে জানুয়ারির নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত।বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ১০ই জানুয়ারি গভীর রাত পর্যন্ত কুমিল্লায় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন। তখন খালেদা জিয়ার সাথে ছিলেন বিএনপির সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশারফ হোসেন।

ওই সময়ের প্রেক্ষাপট মি: হোসেন বলছিলেন, “কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে রাত নয় থেকে ১১টা পর্যন্ত জনসভা করেছেন। আমরা রাত একটার সময় ঢাকায় ফিরে আসি। ১১ তারিখ বিকেলের দিকে জানতে পারলাম যে সেনাবাহিনী থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়েছেন এবং সেখানে কিছু একটা হচ্ছে। জাতিসংঘের কিছু একটা চিঠি নিয়ে সেনাপ্রধান এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টকে দিয়ে জরুরী আইন ঘোষণা করাচ্ছেন।”

সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন সেটি নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র বিরোধের কারণে সহিংস পরিবেশ ছিল অনেকটা সময় ধরে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হবার অনেক আগে থেকেই সে সময় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট রাস্তায় আন্দোলন করছিল। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর ফের ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

যাহোক-
সরকার ২৮ অক্টোবর জনজীবন স্বাভাবিক দেখতে চায়। সেলক্ষ্যে কাজ করছে প্রশাসন। আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। বিএনপি ওই দিন থেকে আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ শুরুর ঘোষণা দিলেও পরে মহাসমাবেশ এর ঘোষণা করে। এর নেপথ্যে কোনো গিট্টু থাকতে পারে বলে আশংকা করছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে কে কেন্দ্র টেনশন বাড়ছে সরকার ও প্রশাসন ও রাজনীতিতে।কি ঘটবে সেদিন এনিয়ে চলছে নানা জল্পনা। তবে সরকার ইতিমধ্যে জনজীবন যাতে স্বাভাবিক থাকে এবং জীবনযাত্রায় যাতে কোনভাবে ব্যাহত না হয় সে নির্দেশনা দিয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, ডিসিদেরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জনজীবন যাতে স্বাভাবিক থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার মধ্যে আগামী ২৮ অক্টোবর জনজীবন ‘স্বাভাবিক রাখার’ নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে সাংবাদিকদের সামনে আসা সচিবের কাছে প্রশ্ন ছিল, ২৮ অক্টোবর নিয়ে সরকারের কী নির্দেশ আছে। জবাবে তিনি বলেন, আমাদের তরফ থেকে সেটা হল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে, কোনো ধরনের জনজীবন যাতে ব্যাহত না হয় সে ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলেছি।ডিসিদেরকেও একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায়ের ‘এক দফার’ আন্দোলনে থাকা বিএনপি ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ‘মহাসমাবেশ’ ডেকেছে। সেদিন থেকে আন্দোলনের আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ শুরুর ঘোষণা দেওয়াকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে ছড়িয়েছে উত্তেজনা।

একই দিন পাল্টা সমাবেশের ডাক এসেছে আওয়ামী লীগের তরফেও। ‘মহাযাত্রার’ ঘোষণা দিয়েছে তারাও।
পাল্টাপাল্টি এই কর্মসূচিতে কেন্দ্র করে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বরের স্মৃতিও ফিরে এসেছে এ কারণে যে, আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।

গত বছরের ডিসেম্বরের ১০ তারিখে ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ ডাকাকে কেন্দ্র করে একইভাবে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। কর্মসূচির তিন দিন আগে নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের পর শেষমেশ সমাবেশটি হয়েছিল সায়েদাবাদের গোলাপবাগ মাঠে। উদ্বেগ ও আতঙ্কে সেদিন ঢাকার মানুষের চলাচল ছিল সীমিত।বিএনপির পক্ষ থেকে প্রথমে আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ ঘোষণা করা হলেও পরে অবশ্য দেওয়া হয়েছে উল্টো বক্তব্য। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরে বলেছেন, ‘মহাসমাবেশ’ থেকে ‘সড়কে বসে পড়ার’ মত কোনো কর্মসূচি আসছে না। শান্তিপূর্ণভাবেই তারা কর্মসূচি পালন করবেন। এরপর নেতা-কর্মীরা যার যার মতো করে ফিরে গিয়ে পরবর্তী কর্মসূচির জন্য অপেক্ষায় থাকবেন।