টুনী হত্যা মামলা নড়বড়ে-ঘাতক স্বামী ভুয়া বাদি দেখিয়ে জামিনে
স্টাফ রিপোর্টার.ঢাকা : হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রির টুনি চরিত্রে অভিনয় করা নায়ার সুলতানা ওরফে লোপা হত্যা মামলার প্রধান আসামি আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জামিন নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আরেকজনকে বাদী সাজিয়ে আদালতে আসামির পক্ষে জামিনের সুপারিশ করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে নায়ার সুলতানার দুই সন্তান সম্পর্কে ভুল তথ্যও।
এসব বিষয় উল্লেখ করে আসামির জামিন বাতিল করে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার জন্য আবেদন করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর আগে বাদীপক্ষের আইনজীবীও এসব বিষয় আদালতকে অবহিত করে জামিন বাতিলের আবেদন করেছেন।
গত ১৬ অক্টোবর রাতে গুলশান ১ নম্বরের ১২৬ নম্বর রোডে নিজ ফ্ল্যাট থেকে নায়ার সুলতানার লাশ উদ্ধার করে গুলশান থানার পুলিশ। লাশটি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলন্ত ছিল। পুলিশ সুরতহালে উল্লেখ করে, নায়ারের দুই পায়ের হাঁটু খাটের সঙ্গে লাগানো, অর্ধ বসা অবস্থায়। গলার ডান দিকে কালো দাগ ও বাঁ হাতের গিরায় আঘাতের কাটা দাগ।
ওই সময় নায়ারের পরিবার অভিযোগ করে, নায়ারকে শ্বাসরোধে হত্যা করে আত্মহত্যা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেছেন স্বামী আলী আমিন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিনই গুলশান থানার পুলিশ আলী আমিনকে গ্রেপ্তার করে।
নায়ারের মা রাজিয়া সুলতানা বাদী হয়ে আলী আমিন ও তাঁর মা-বাবার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। ১৭ অক্টোবর গুলশান থানার পুলিশ আলী আমিনকে ঢাকার মহানগর মুখ্য হাকিম (সিএমএম) আদালতে পাঠিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত আলী আমিনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে গত নভেম্বরে মহানগর দায়রা জজ আদালতে আলী আমিনের জামিনের আবেদন করা হলে দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর করেন।
আদালতের নথিপত্রে দেখা যায়, জামিনের শুনানিকালে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, নায়ার সুলতানা খুন হননি, আত্মহত্যা করেছেন। আসামির দুটি ছেলে আছে, যাদের বয়স যথাক্রমে দুই ও ছয় বছর। তাদের মা মারা যাওয়ায় ও বাবা জেলহাজতে থাকায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। মামলার বাদিনী আসামির শাশুড়ি রাজিয়া সুলতানা এ অবস্থা বুঝতে পেরে ঢাকার মুখ্য হাকিম আদালতে (সিএমএম) হাজির হয়ে আসামিকে জামিন দিলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য যথাযথ বলে মন্তব্য করে আদালত আলী আমিনের জামিন মঞ্জুর করেন।
তবে মামলার বাদী রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘আদালতে আমার ও আমার মেয়ের সন্তানদের ব্যাপারে ভুল তথ্য দিয়ে আসামি জামিন নিয়েছেন। আমি কখনো সিএমএম আদালতে গিয়ে আসামির জামিনের পক্ষে বলিনি। আর আমার মেয়ের দুই ছেলে নয়, আছে দুই মেয়ে; যাদের বয়স ৬ ও ১০। আসলে আসামিপক্ষ অন্য কোনো নারীকে বাদী সাজিয়ে এ কাজ করেছে।’
রাজিয়া বলেন, ‘আমার ব্যাপারে আদালতে এমন ভুয়া তথ্য দিয়ে আসামির জামিন নেওয়ার কথা শুনে আমি সত্যিই হতবাক। আমি আইনজীবীর মাধ্যমে এ ঘটনা আদালতকে অবহিত করে জামিন বাতিল চেয়েছি। অন্যদিকে প্রথমে মামলাটি থানা-পুলিশের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছিল। আরও সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমি মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তরের জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর আবেদন করি। গত ১৭ মে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়।’
২ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উত্তরা ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) উত্তম কুমার বিশ্বাস সিএমএম আদালতে আসামির জামিন বাতিল করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আবেদনে সিআইডি কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘ঘটনাস্থল ফ্ল্যাটটি নায়ার সুলতানার নামে। ফ্ল্যাট বুঝে না দেওয়ায় আসামিরা গত ১৬ অক্টোবর বেলা আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে নায়ারকে হত্যা করে। পরে আলী আমিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করলে মামলার ২ নম্বর ও ৩ নম্বর আসামি যোগসাজশ করে বিজ্ঞ আদালতে ভুয়া মহিলাকে মামলার বাদী সাজিয়ে উপস্থাপন করে।’
এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আসামিকে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে সিআইডি কার্যালয়ে হাজির হয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করার নির্দেশ দেন। কিন্তু গতকাল সোমবার পর্যন্ত আসামিপক্ষের কেউ এ নির্দেশ পালন করেননি বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি উত্তম কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আসামি বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। ঢাকার জোয়ারসাহারা ও চট্টগ্রামের এক ঠিকানায় খোঁজ নিয়েও তাঁর ও তাঁর পরিবারের কোনো সন্ধান পাইনি।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী নজিবুল্লাহ হিরো বলেন, বাদী আসামির জামিন চাইলে বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য এফিডেভিট করতে হয়, বাদীর পক্ষে ওকালতনামা থাকতে হয়। থাকতে হয় বাদীর স্বাক্ষরও। কিন্তু নায়ার সুলতানা হত্যা মামলার ক্ষেত্রে এর কোনো কিছুরই তথ্য-প্রমাণ নেই। শুধু সিএমএম আদালত গত ১৭ অক্টোবর যে অবজারভেশন দিয়েছিলেন, সেখানে বাদী আসামির জামিনে আপত্তি না থাকার কথা বলেছেন বলে লেখা ছিল। এই অবজারভেশনটিই আসামিপক্ষের আইনজীবী মহানগর দায়রা জজ আদালতে উপস্থাপন করে জামিন নেন। কিন্তু বাদী হিসেবে যিনি উপস্থিত ছিলেন, তিনি আসল কি না, তার কোনো তথ্য-প্রমাণ আদালতের নথিতে নেই।
আসামি আলী আমিনের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। ২ জুন জামিন বাতিলের আবেদনের শুনানিতে আসামিপক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল। বাদীর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সম্প্রতি এ মামলা দেখছি। অভিযোগ সম্পর্কে তো আগে শুনিনি। আমি নথি দেখে বলতে পারব।’
এদিকে, গত বছর ১২ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ নায়ারের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে নায়ারের মৃত্যু আত্মহত্যাজনিত বলে উল্লেখ করা হয়। পরে এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নায়ারের পরিবার আদালতে পুনঃময়নাতদন্তের আবেদন করে। আদালতের নির্দেশে লাশ উত্তোলন করে পুনঃময়নাতদন্ত করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তিন সদস্যের একটি দল। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে হত্যার কারণ ও ধরন শনাক্ত করা যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।
সিআইডি জানায়, তারা এখন দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেদনে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো মন্তব্য না থাকায় ঘটনার তদন্তে আসামিকে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন। কিন্তু আইনগতভাবে তা তারা করতে পারছে না।