জেলা পরিষদ ভোট-বিএনপির ভাষায় তামাশা নির্বাচন-বিনা ভোটে জিতেছে ২১
জাতিরকন্ঠ রিপোর্ট : জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পর দেশে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলছে ৬১ জেলায়।জেলা পরিষদ ভোট নিয়ে বিএনপি নেতারা বিদ্রুপ করে বলেছে তামাশার নির্বাচন-।এদিকে বিনা ভোটে জিতেছে ২১ জন।
জেলা ও উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত ৮৩৬টি ভোট কেন্দ্রে বুধবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত একটানা ভোট চলবে। নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে।
প্রায় ক্ষমতাহীন এই পরিষদের নির্বাচনে সরাসরি ভোটের বিধান না থাকায় জনগণের মধ্যে তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি।স্থানীয় সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই কেবল ভোট দিয়ে নিজ নিজ জেলায় একজন করে চেয়ারম্যান এবং ২০ জন সদস্য নির্বাচিত করবেন জেলা পরিষদ নির্বাচনে।
ঢাকার আগারগাঁও তালতলা সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় ও মহিলা কলেজ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মো. মঈনুল হোসেন জানান, তারা সব প্রব প্রস্তুতি শেষ করে নির্ধারিত সময় সকাল ৯টায় কেন্দ্র খুলেছেন। প্রথম ভোটটি পড়েছে সোয়া এক ঘণ্টা পর। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বর্জনের মধ্যে এ নির্বাচনে ২১ জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। বাকি অধিকাংশ জেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতারাই।
তারপরও নির্দলীয় এ নির্বাচনে প্রভাব খাটানো, ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোট কেনাবেচা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। ভোটের আগের দিনও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে আড়াই লাখ টাকাসহ এক সদস্য প্রার্থীর সমর্থককে আটক করেছে পুলিশ।
ভোট প্রভাবমুক্ত রাখতে ইসির পক্ষ থেকে স্পিকারকে চিঠি দিয়ে সাংসদদের এলাকা ছাড়তে বলা হয়েছে। জামালপুরের পুলিশ সুপারকে করা হয়েছে প্রত্যাহার। ভোটার সংখ্যা কম হলেও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে বড় আয়োজন। প্রতিটি কেন্দ্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি থাকছেন নির্বাহী হাকিমরা। নিয়ম হয়েছে, কোনো ভোটার মোবাইল ফোন বা কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। কেন্দ্রের ভেতরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন কেবল থানার ওসি।
সব মিলিয়ে ভোটার সংখ্যা ৬৩ হাজারের কিছু বেশি হলেও এ নির্বাচন আয়োজনে ইসির খরচ হবে সোয়া পাঁচ কোটি টাকা। সাধারণ জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকছে না বলে বুধবার নির্বাচনী এলাকায় সাধারণ ছুটি নেই। তবে ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্থাপনাগুলোর সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, এ নির্বাচনের জন্য প্রতিটি জেলার সীমানা ১৫টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। তিনটি করে ওয়ার্ড নিয়ে হবে একটি সংরক্ষিত ওয়ার্ড, যার সদস্য হবেন একজন নারী। প্রতিটি জেলায় একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সাধারণ সদস্য এবং ৫ জন সংরক্ষিত সদস্য নির্বাচিত করা হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভোট দেবেন এ নির্বাচনে। মোট ৬৩ হাজার ১৪৩ জন ভোটারের মধ্যে ৪৮ হাজার ৩৪৩ জন পুরুষ, ১৪ হাজার ৮০০ জন নারী।
ভোটের প্রার্থী যারা-
চেয়ারম্যান পদে ১৪৬ জন, সাধারণ সদস্য পদে ২ হাজার ৯৮৬ জন এবং সংরক্ষিত সদস্য পদে ৮০৬ জন লড়ছেন। সব মিলিয়ে প্রার্থী সংখ্যা ৩ হাজার ৯৩৮ জন। চেয়ারম্যান পদের ব্যালট সাদা, সাধারণ ওয়ার্ডের সদস্য পদের জন্য সবুজ এবং নারী সদস্য পদের জন্য রয়েছে গোলাপী ব্যালট। এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসক। আর তার সহকারী হিসেবে রয়েছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অন্য নির্বাচন কর্মকর্তারা।
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসির অধীনে এটাই হবে শেষ নির্বাচন। সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের পর জেলা পরিষদেও ভোট করছে এই কমিশন।
২০০০ সালে আইন প্রণয়ন হলেও ১৬ বছর পর হতে যাচ্ছে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন। তবে সরাসরি ভোটের বিধান না রাখার সমালোচনাও উঠেছে।
বিএনপি বলেছে- তামাশার নির্বাচন-
এই নির্বাচন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে ভোট বর্জন করেছে বিএনপি। ‘তামাশার নির্বাচনও’ বলছেন দলটির নেতারা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ একে আইয়ুব খানের ‘বেসিক ডেমোক্রেসি’র সঙ্গেও তুলনা করেছেন। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও নির্দলীয় এই নির্বাচন থেকে দূরে থেকেছে। বেশিরভাগ দলের বর্জনের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে স্থানীয় পর্যায়ে পদ-পদবির দেওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের ভারসাম্য আনতে দেখা গেছে এই নির্বাচনে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে প্রার্থী করার পর মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যজন আনোয়ার হোসেনকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দাঁড় করানো হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে আনোয়ার হোসেনের মতো আরও ২০ জেলায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২১ জন-
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতরা হলেন- নারায়ণঞ্জে আনোয়ার হোসেন, গাজীপুরে মো. আখতারুজ্জামান, ঠাকুরগাঁওয়ে সাদেক কোরাইশী, জয়পুরহাটে আরিফুর রহমান রকেট, নাটোরে সাজেদুর রহমান খাঁন, সিরাজগঞ্জে আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, যশোরে শাহ হাদিউজ্জামান, বাগেরহাটে শেখ কামরুজ্জামান টুকু, ঝালকাঠিতে সরদার শাহ আলম, ভোলায় আব্দুল মোমিন টুলু, নেত্রকোনায় প্রশান্ত কুমার রায়, মুন্সীগঞ্জে মো. মহিউদ্দিন, দিনাজপুরে আজিজুল ইমাম চৌধুরী, নওগাঁয় এ কে এম ফজলে রাব্বি, ফেনীতে আজিজ আহমেদ চৌধুরী, কিশোরগঞ্জে মো. জিল্লুর রহমান, ঢাকায় মো. মাহবুবুর রহমান, হবিগঞ্জে মো. মুশফিক হুসেন চৌধুরী, চট্টগ্রামে এম এ সালাম, টাঙ্গাইলে ফজলুর রহমান খান ফারুক ও ফরিদপুরে মো. লোকমান মৃধা।
তবে বাকি জেলাগুলোতে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হওয়াদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন দলটির বিদ্রোহী নেতারা। এর মধ্যে পাবনায় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন মন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর মেয়ে। ৩৯ জেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোটে রয়েছেন ১২৪ জন। এসব জেলার মধ্যে অন্তত ৩৭টিতে ক্ষমতাসীন দলের ৭৭ জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে।
ওবায়দুল কাদের বলেন-
এই বিদ্রোহী প্রার্থীদের আটকানোর চেষ্টা আওয়ামী লীগও করেনি। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা একটা পর্যায়ে চিন্তা করলাম যে, অপজিশন নেই ইলেকশনটায়, একেবারেই আনঅপোজড সবাই হয়ে যাবে, এটা কেমন যেন একটা রং মেসেজ যায়। যারা প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্বাচন করছে, দলীয় লোক হলেও তাদের প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ বা কনভিন্স করা- সে বিষয়টা আছে, কিন্তু চাপাচাপিটা করা থেকে আমরা বিরত থেকেছি।
টাকা ছড়ানোর অভিযোগ-
ইসির হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, অনেক প্রার্থী তাদের জয় নিশ্চিত করতে ভোটারদের বলেছেন ক্যামেরায় ছবি তুলে আনতে, কেউ বলেছেন ব্যালট পেপারের পেছনে বিশেষ চিহ্ন দিতে। এর মধ্যে টাকা ছড়ানোর অভিযোগটিই বেশি উঠেছে। মঙ্গলবারও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে আড়াই লাখ টাকাসহ জেলা পরিষদ নির্বাচনে এক সদস্য প্রার্থীর সমর্থককে আটক করেছে পুলিশ।
নিরাপত্তায় প্রায় ২৩ হাজার সদস্য-
ভোট কেনা-বেচার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এখানে টাকার যে একটা ভূমিকা আছে, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই ভোটের নিরাপত্তায় বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় ২৩ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র পাহারায় থাকবে ২০ জন পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান, ব্যাটালিয়ান আনসার ও আনসার ভিডিপির সদস্য। টহলে থাকবে বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা। এ নির্বাচনটিও আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জের। সব মিলিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো এ নির্বাচনে সুষ্ঠু করতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, বলেন সচিব।