জেএমবি নিয়ে মহা তুলকালাম-ক্রস ২-সম্রাট ফারদিন ঢাকায়
এস রহমান/মোস্তফা কামাল প্রধান/ প্রদীপ শীল: চট্টগ্রামের হাটহাজারীর রাইফেল, গুলি, বিস্ফোরক উপাদান, সামরিক পোশাক এর জোগানদাতা জেএমবি সম্রাট ফারদিন এখন ঢাকায়। তাঁকে হন্য হয়ে খুঁজছে গোয়েন্দারা। এদিকে এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জুগিরচালা এলাকায় রোববার গভীর রাতে ‘জঙ্গি আস্তানায়’অভিযান চালিয়েছে র্যাব।
জুগিরচালায় ‘জঙ্গি আস্তানায়’ র্যাবের অভিযানে দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, নিহত দুই ব্যক্তি গতকালই কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।এর আগে শনিবার গভীর রাতে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। সেখান থেকে একটি ‘স্নাইপার রাইফেল’, গুলি, বিস্ফোরক, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, সেনাবাহিনীর ১২ সেট পোশাক এবং জেএমবির কিছু সাংগঠনিক কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপপরিচালক মেজর মাকসুদ আলম বলেন, র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, একটি জঙ্গি আস্তানায় র্যাব সদস্যরা অভিযান চালাতে গেলে র্যাবকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়লে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান রাত সোয়া দুইটার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফিং করে জানান, জায়গাটি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির একটি আস্তানা। ঘটনাস্থল থেকে চারটি অবিস্ফোরিত হাতে তৈরি গ্রেনেড (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস-আইইডি) উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। আর জঙ্গিদের বিস্ফোরিত বোমায় একজন র্যাব সদস্য আহত হয়েছেন। জঙ্গিদের কাছে থাকা একটি ব্যাগ থেকে বেশ কিছু বিস্ফোরক, ডেটোনেটরসহ গ্রেনেড তৈরির উপকরণ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সড়কের পাশের পরিত্যক্ত ওই জায়গায় জঙ্গিরা সভা করত বলে তাঁদের কাছে খবর ছিল। ঘটনাস্থলে ওই দুজনই শুধু ছিল দাবি করে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, র্যাব সদস্যরা জায়গাটি ঘেরাও করে অভিযান শুরু করেন। এখান থেকে কেউ পালাতে পারেনি। তাঁরা জেএমবির সদস্য বলে জানালেও নিহত দুই ব্যক্তির নাম জানা যায়নি বলে তিনি জানান। তবে তাঁরা নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন বলে ধারণা মুফতি মাহমুদের। জয়দেবপুর থানার পুলিশ জানিয়েছে, র্যাব-১-এর সদস্যরা এ অভিযান চালান। নিহত দুজনের নাম মিনহাজুল ও মাহবুব বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এদিকে গতকাল রাতে অন্তত তিনটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ঘটনাস্থল থেকে র্যাবের অভিযান সরাসরি দেখাচ্ছিল। রাত দুইটার দিকে র্যাবের পক্ষ থেকে অভিযান নিয়ে তেমন কিছু না বলা হলেও টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখানো হচ্ছিল গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস সড়কের পাশে মাঠের ওপর একটি পরিত্যক্ত ভবন বোমা বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাঠের ওপর বিশেষ লাইটিং ইউনিট দিয়ে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই ভবনটিতেই জঙ্গিরা আস্তানা গেড়েছিল বলে টিভি চ্যানেলগুলোর সরাসরি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছিল।
এদিকে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ গতকাল গভীর রাতে জানান, গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে বন্দী ছিলেন জঙ্গি মিনহাজুল ও মাহবুব। গতকাল দুপুরে তাঁদের দুজনের জামিন হয়। তাঁরা কারাগার থেকে জামিনে বের হলে র্যাব-১-এর সদস্যরা ওই দুই জঙ্গিকে হেফাজতে নেন। তিনি জানান, এ বিষয়ে র্যাব তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
এর আগে গত বুধবার রাত থেকে ১৪ ঘণ্টার অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মিরপুরের একটি বাসার ছয়তলা থেকে তিন জেএমবি সদস্যকে গ্রেপ্তার ও ১৬টি হাতে তৈরি গ্রেনেড উদ্ধার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ওই অভিযানটিও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সরাসরি দেখানো হয়।
গত শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গি আস্তানাটির সন্ধান পাওয়া গেছে।গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন হলেন নাইমুর রহমান (বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী), ফয়সাল মাহমুদ (নোয়াখালীর সেনবাগ) ও শওকত রাসেল (কক্সবাজারের মহেশখালী)। তাঁরা তিনজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তরের ছাত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী বলেন, পুলিশের কাছ থেকে কাগজপত্র পেলে যাচাই-বাছাই করে এই তিনজনের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।
পুলিশ বলছে, এই তিনজন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার মো. ফারদিন ওরফে নোমানের সহযোগী। এই ফারদিনকে পুলিশ এখনো ধরতে পারেনি। আটক এই তিনজন জানিয়েছেন, ফারদিন কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে গেছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আবদুল জলিল মণ্ডল গতকাল রোববার সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধার হওয়া এমকে ১১ স্নাইপার রাইফেলটি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। এটি দিয়ে প্রতি মিনিটে ৭৫০টি গুলি করা যায়। তিনি বলেন, বড় ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে জঙ্গিরা এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুত করেছিল।
জেএমবির তিন সদস্যকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি বাসা থেকে গত শনিবার গভীর রাতে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। এদিকে গত রাতে বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, চট্টগ্রামে উদ্ধার হওয়া রাইফেলের সঙ্গে ইন্টারনেটে পাওয়া স্নাইপার রাইফেলের ছবির মিল নেই। এ অমিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. বাবুল আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটি পুরোনো ধরনের এমকে ইলেভেন। তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তিনি আলাপও করেছেন।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ জানায়, গত ৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের খোয়াজনগর এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ গুলি, অস্ত্র, গ্রেনেড ও বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। সেই সূত্র ধরে শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম শহরের কাজীর দেউড়ি থেকে নাইমুর রহমানকে, বিকেলে উত্তর নালাপাড়া থেকে ফয়সাল মাহমুদকে ও সন্ধ্যায় পাঁচলাইশের কসমোপলিটন এলাকা থেকে শওকত রাসেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল হাটহাজারী থানার আমানবাজার জয়নব কলোনিতে জেএমবির কমান্ডার ফারদিনের ভাড়া বাসায় অভিযান চালায়।
অভিযানের নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. বাবুল আক্তার।
তিনি বলেন, গত ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তাঁরা চট্টগ্রামে জঙ্গিদের নতুন করে সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন। জেএমবি তহবিল সংগ্রহের জন্য ওই ছিনতাই করতে যায়। তখন নিজেদের গ্রেনেড বিস্ফোরণে জেএমবির দুই সদস্য নিহত হন। ওই সূত্র ধরে ৫ অক্টোবর খোয়াজনগর থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ জেএমবির পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে ফারদিন সম্পর্কে জানা যায়। ফারদিনকে খুঁজতে গিয়ে শনিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে আটক করা হয়। তাঁদের মধ্যে শওকত রাসেল ফারদিনের বাসার সন্ধান দেন।
পুলিশ জানায়, ওই বাসা থেকে একটি স্নাইপার রাইফেল ও এক জোড়া র্যাঙ্ক ব্যাজসহ সেনাবাহিনীর ১২ সেট পোশাক ছাড়াও ২৫০টি গুলি, পাঁচ কেজি বিস্ফোরক জেল, ১০টি ডেটোনেটর, বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম, ‘জিহাদি’ বই ও জেএমবির সাংগঠনিক কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গতকাল হাটহাজারী থানায় তিনটি মামলা হয়েছে।
ওই বাড়ির মালিক ইছহাক বলেন, ছয় মাস আগে ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে নাফিস নামের এক ব্যক্তি মাসিক ছয় হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া নেন। বাসায় নাফিসের স্ত্রী ও একটি ছোট ছেলে থাকত। গত সেপ্টেম্বরে তাঁর স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে চলে যান। নাফিস মাঝেমধ্যে আসতেন। তাঁর বাড়ি ঢাকায় বলে জানিয়েছেন। সর্বশেষ ১০ দিন আগে নাফিস বাসায় এসেছিলেন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ফারদিন নাফিস নাম দিয়ে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন। তাঁকে ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক গবেষণা পরিচালক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক আবদুর রব খান গত রাতে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, জঙ্গি আস্তানা থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক উদ্ধার আর তা ব্যবহারের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য কী, সেটি বিশেষভাবে উদ্বেগের বিষয়। কারণ, সেনাবাহিনীর পোশাককে ক্যামোফ্লাজ হিসেবে ব্যবহার করে যদি তাঁরা সেনানিবাসে বা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালান, তা অত্যন্ত ভয়ের ব্যাপার হবে।
পুলিশ কমিশনার মো. আবদুল জলিল মণ্ডল গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এখনো তেমন কিছুই জানা যায়নি। প্রসঙ্গত, এর আগে ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটি ঈশা খাঁর দুটি মসজিদে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় নৌবাহিনীর দুই বেসামরিক কর্মচারী আটক হন।
এদিকে নোয়াখালী অফিস জানায়,চট্টগ্রামে আটক ফয়সাল মাহমুদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার উত্তর মোহাম্মদপুরে। সেখানে পরিবারের কেউ থাকেন না। তাঁর চাচা হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, ফয়সালের বাবা ছায়েদুল হক চট্টগ্রামের একটি কারখানায় চাকরি করতেন। সপরিবারে চট্টগ্রামের উত্তর নালাপাড়া এলাকায় থাকতেন। ফয়সালের জন্ম চট্টগ্রামে।
মহেশখালী (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান,আটক আরেকজন শওকত রাসেলের বাড়ি মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা গ্রামে। তাঁর বাবা নুরুল আমিন বলেন, তিনি ১৯৬৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এখন তিনি কক্সবাজার জেলা মৎস্যজীবী লীগের সহসভাপতি। তিনি দাবি করেন, তাঁর একমাত্র ছেলে রাসেল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, জেএমবির সঙ্গে জড়িত নন।