জেএমবির হাতে ‘সুইসাইড ভেস্ট’ স্নাইপার-সহ নানা গোপন মিশন
বিশেষ প্রতিবেদক : নিষিদ্ধ জেএমবির হাতে ‘সুইসাইড ভেস্ট’ স্নাইপার রাইফেলসহ নানা মারনাস্ত্র।ডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, মিরপুরের আস্তানা থেকে যে ‘সুইসাইড ভেস্ট’ পাওয়া গেছে, তা আত্মঘাতী হামলা ছাড়াও আরও এক ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উগ্রপন্থীরা ওই ভেস্টের ভেতরে একইসঙ্গে বিস্ফোরক, অস্ত্র, গুলি-টাকাও রাখে। অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রেও সৈনিকরা এ ধরনের ভেস্ট ব্যবহার করেন।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) সংগঠনের নিজস্ব স্টাইলে ‘আত্মঘাতী স্কোয়াড’ তৈরি করছে। বিশ্বের অন্যান্য উগ্রপন্থি ‘আত্মঘাতী স্কোয়াডে’র সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্যরা প্রথমে নিরাপদে থেকে হামলার চেষ্টা করেন; সম্ভব না হলে প্রয়োজনে মিশন সফলের জন্য আত্মাহুতি দিচ্ছেন। আইএস ও আল কায়দার সদস্যরা জানবাজি রেখে আত্মঘাতী হামলা চালায়। বাংলাদেশে জেএমবির সদস্যরা অতটা ‘কমিটেড’ নয়।
একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তার মন্তব্য, দেশে জেএমবির নতুন এমন কৌশলের পর বর্তমান বাস্তবতায় এ পর্যায়ে শেকড় ছিন্ন না করলে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে জেএমবি।
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শুভাডাঙ্গা ইউনিয়নে একটি আহমদিয়া মসজিদে ‘আত্মঘাতী’ হামলায় একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হন। এর আগে চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঘাঁটি ঈশা খাঁর দুটি মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির তিন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ সদস্যসহ সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় তৈরি গ্রেনেড ও বিস্ফোরক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, রাজশাহীর বাগমারায় মসজিদে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি ‘আত্মঘাতী’ কি-না, তা পুলিশ তদন্ত করে দেখছে। দু’জন ওই সময় উপস্থিত ছিল। তাদের একজনের কাপড়ের ভেতর থেকে বোমার বিস্ফোরণ হয়। আরেকজন পালিয়ে যায়। হয়তো কাপড়ে বেঁধে যাওয়ায় ছুড়ে মারার আগেই বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। বোমাটি বাংলাদেশে তৈরি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা করছে জেএমবি। পেছন থেকে একটি গ্রুপ তাদের ইন্ধন দিচ্ছে। হামলা চালাতে দুটি কৌশল ব্যবহার করে জেএমবি সদস্যদের মোটিভেশন দেওয়া হতে পারে। একটি মতাদর্শগত, অন্যটি আর্থিকভাবে উগ্রবাদীদের প্রণোদনার মাধ্যমে। জেএমবি ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও শিয়া মতাবলম্বীদের টার্গেট করে হামলা করছে। এ ধরনের হামলা পাকিস্তানে অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডার ইসফাক এলাহী চৌধুরী বলেন, জেএমবি পুরনো কৌশল নতুনভাবে প্রয়োগ করছে। বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক জঙ্গি এ ধরনের সাহস পাচ্ছে। এখনই জঙ্গিবাদের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, জেএমবি নাশকতার ছক তৈরি করে কোন নেতাকে কোন দায়িত্ব দিয়েছে, তা শনাক্ত করে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জেএমবির সব পর্যায়ের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে কঠোর নজরদারি রয়েছে।
ডিবির সহকারী কমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্যরা শতভাগ মোটিভেটেড নয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরা নিরাপদ থেকে হামলা করার পরিকল্পনা করে।জানা গেছে, রাজধানীর হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলা, আশুলিয়ায় চেকপোস্টে পুলিশ হত্যার ঘটনাও নিজস্ব স্টাইলে জেএমবির ‘আত্মঘাতী স্কোয়াডে’র সদস্যরা করেছে। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জেএমবির সদস্য আলবানি ওরফে হোজ্জা নিহত হন। তিনি জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য।
দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি গ্রেফতার একাধিক জেএমবি নেতা জানান, সারাদেশে বর্তমানে জেএমবির ৪-৫ জন বোমা তৈরির কারিগর রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, বগুড়ার জান্নাতুল ফেরদৌস। পাঁচ ধরনের উপাদান ব্যবহার করে জেএমবি বর্তমানে গ্রেনেড তৈরি করে। এর মধ্যে ডেটনেটর ও জেল পাশের একটি দেশ থেকে আনা হয়। এর সঙ্গে সার্কিট যুক্ত করে ঘরে বসেই গ্রেনেড বানানো হয়। মিরপুরের ওই বাড়িটি গ্রেনেড ও বোমা তৈরি এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
চার মাসে ওই জঙ্গি আস্তানায় এ পর্যন্ত ১০ জনকে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী, বগুড়া ও চট্টগ্রামে সম্প্রতি কয়েকটি অপারেশনে ব্যবহৃত গ্রেনেড মিরপুরের আস্তানা থেকে নেওয়া হয়। জেএমবি যে আস্তানায় গ্রেনেড ও বোমা তৈরি করে সেটি ‘কোম্পানি কমান্ডিং’ কার্যালয়। সেখান থেকে অস্থায়ীভাবে দেশের যেসব জায়গায় গ্রেনেড ও গোলাবারুদ পাঠানো হয়।