‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক,মুছে যাক গ্লানি’ আজ চৈত্রসংক্রান্তি কাল নববর্ষ
সাইফুল বারী মাসুম : ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক, মুছে যাক গ্লানি’ এই প্রণতির ভেতর রাত পোহালেই নতুন দিন। পূর্বদিগন্ত উদ্ভাসিত করে ভোরের নরম আলো রাঙিয়ে দেবে চরাচর, স্বপ্ন, প্রত্যাশা। নব সম্ভাবনায় সূচিত হবে নববর্ষ। চৈত্র সংক্রান্তি আজ। বাংলা সনের সবশেষ মাস চৈত্রের শেষ দিন। এক ক্রান্তি হতে ঊঠে আরেক ক্রান্তিতে সংক্রান্তি। বাংলা সনের সমাপনী মাস চৈত্রের এ শেষ দিনটি সনাতন বাঙালির লৌকিক আচারের ‘চৈত্র সংক্রান্তি’। আজ ৩০ চৈত্র ১৪২৩। বাংলা সনে বছরের শেষদিন। প্রকৃতির আকুল করা ফাগুন, চৈতালী হাওয়ায় উতল-উদাস করা যে বসন্ত তারও বিদায় আজ। বসন্ত মুখর হয়ে উঠেছিল তরুলতা, বিটপী আর বনস্পতিতে। এবারে ঋতুরাজ বসন্তের বড়ভাগ জুড়েই ছিল খরতাপ। তপ্ত দিনলিপিতে এবার বৃষ্টির শান্ত-শীতল পরশও জুটেছিল জনজীবনে। ঝড়-ঝঞ্ঝাও বাদ যায়নি। তবে এই এখন দিবসের আকাশ যেন আগুন ঢালছে।
সনাতন হিন্দু সমপ্রদায় বাংলা মাসের শেষ দিনে শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস ক্রিয়াকর্মে কাটান। মূলত স্বামী, সংসার, কৃষি, ব্যবসার মঙ্গল কামনায় লোকাচারে বিশ্বাসী নারী ব্রত পালন করেন। এ সময় আমিষ নিষিদ্ধ থাকে। থাকে নিরামিষ শাক-সবজি আর সাত রকমের তেতো খাবারের ব্যবস্থা। বাড়ির আশপাশ থেকে শাক তুলে রান্না করেন গৃহিণীরা। গ্রামের গৃহিণীরা মাটির ঘরদোর লেপাপোছা করেন। মেঝেতে আলপনাও আঁকেন অনেকে। ভিটেসহ রান্নাঘর, গোয়ালঘর সবই পরিষ্কার করা হয়। সকালে গরুর গা ধুয়ে দেয় রাখাল বালক। এদিন ঘরে ঘরে চলে বিশেষ রান্না। উন্নতমানের খাবার ছাড়াও তৈরি করা হয় নকশি পিঠা, পায়েস, নারকেলের নাড়ু। সচ্ছল গেরস্তরা নতুন জামা-কাপড় পরে একে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যান। খোশগল্প করে সময় কাটান।
আচার অনুযায়ী এ দিনে বিদায় উত্সব পালন করে ব্যবসায়ী সমপ্রদায়। দোকানপাট ধুয়ে-মুছে বিগত বছরের যত সব জঞ্জাল, অশুচিতাকে দূর করতে চায়। কারণ রাত পেরোলেই খোলা হবে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের নতুন খাতা। সে উত্সবের চিরচেনা নাম ‘হালখাতা’। ওই উত্সবে পরিচ্ছন্ন থাকে বিপণী প্রতিষ্ঠান, ধূপের সুগন্ধি ভারী করে রাখে ঘরের পরিবেশ। অতিথি এলেই গোলাপ পানি ছিটিয়ে হয় তাদের অভ্যর্থনা। রেওয়াজ অনুযায়ী এই দিনটিই সারা বছরের খরিদ্দারদের কাছে বকেয়া টাকা তোলার শুভদিন ভাবা হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির সবচেয়ে বড় আয়োজন চড়ক পূজা। চৈত্র মাসজুড়ে সন্ন্যাসীরা উপবাস, ভিক্ষান্নভোজন প্রভৃতি নিয়ম পালন করেন। সংক্রান্তির দিন তারা শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঝোলে। এ আয়োজনের সঙ্গে আরো চলে গাজনের মেলা। এ সময় একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা করে অন্য গ্রামের শিবতলায় যাওয়া হয়। দুই জন শিব ও গৌরী সেজে নৃত্য করেন। চৈত্র সংক্রান্তির পরের দিনটিই পহেলা বৈশাখ। তাই সনাতন ধর্মের অনুসারীরা এ দিনটিকে খুবই পুণ্যের দিন বলে মনে করেন। তাদের ধর্মে দিনটিকে গণ্য করা হয় মহাবিষুব সংক্রান্তি।
গাজনের মেলা ছাড়াও হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। এদিকে আদিবাসী সমপ্রদায় এ দিনে পালন করে বৈসাবি উত্সব। নানা আয়োজনে চৈত্রসংক্রান্তির পার্বণ আবার ঠিক একই সঙ্গে দুয়ারে কড়া নাড়ছে পহেলা বৈশাখ। রাত শেষ হলেই নতুন দিন, তবে এটা শুধু নতুন দিনই নয়, নতুন বছরও বটে। নতুন বর্ষ। বৈশাখকে বরণ করার করতে সবখানেই এখন চলছে সাজসাজ রব। বাংলা নববর্ষকে বরণের জন্য ছায়ানটের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। রমনা বটমূলে হয়েছে মঞ্চ নির্মাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা।