`জিয়া চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে তাহেরকে হত্যা করে’
দিনা করিম.ঢাকা:
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের (বীর উত্তম) স্ত্রী লুৎফা তাহের বলেছেন, জিয়াউর রহমান কর্নেল আবু তাহেরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমান বন্দী হলে তার মুক্তির জন্য কর্নেল তাহেরকে ফোন করেছিলেন। ৭ নভেম্বর সিপাহীদের সহায়তায় কর্নেল তাহের জিয়াকে মুক্ত করেন। তাহের জিয়াউর রহমানের জীবন রক্ষা করলেও তিনি চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়ে তাহেরকে হত্যা করেছেন। শুধু তাই নয়, হত্যাকাণ্ডের পর তাহেরের কবরে পর্যন্ত সেনা পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন জিয়া। তবে আমরা কখনো ভাবিনি, কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হবে। আমাদের ধারণা ছিল তাকে সাজা দেয়া হতে পারে। কিন্তু জেনারেল জিয়া যে এতো নিষ্ঠুর ছিল তা জানতাম না।
গতকাল ইত্তেফাকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। লুৎফা তাহের বলেন, ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের নায়ক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সহ-সভাপতি কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে ঢাকা কেন্দ ীয় কারাগারে ফাঁসি দেয়া হয়। এটি ছিল ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাযজ্ঞ। সশস্ত্র বাহিনীতে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগে তাহেরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের কথিত অভিযোগ আনা হয়েছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে কথিত অভিযোগে তাহেরসহ জাসদের ৩৩ জন নেতা-কর্মীকে গোপন বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করান। তড়িঘড়ি করে ৩৩ জন জাসদ নেতা-কর্মীর বিচার শুরু করেন।
তিনি বলেন, হঠাৎ করেই কর্নেল তাহেরের বিচার চাওয়া হয় নি। কর্নেল তাহের পরিবার, জাসদ ও কর্নেল তাহের সংসদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ফাঁসির নামে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিচারের নথিপত্র চেয়ে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আমাদের আবেদনে সরকার সাড়া দেয়নি। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে কর্নেল তাহেরের প্রহসনের বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ বন্ধ হয়েছিল।
তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কোথায় রাখা হয় তার কোন খবর ছিল না আমাদের কাছে। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই তার ফাঁসির রায় দেয়া হয়। ১৯ জুলাই বেলা ২টার দিকে কারাগারে তাহেরের সাথে দেখা করার জন্য পরিবারের সদস্যদের খবর দেয়া হয়। বিকাল ৩টায় কারাগারের ৮ নম্বর সেলে আমাদের সাথে তার শেষ দেখা করানো হয়। এসময়ে তাকে স্বাভাবিক দেখা যাচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কখনো বিচ্ছিন্ন রাজনীতি করিনি। ক্ষুদিরামের পর আমি অপরাজনীতির শিকার। যে জিয়াকে আমিবাঁচিয়ে ছিলাম সেই আমার সঙ্গে বেঈমানি করেছে।’ শেষ মুহূর্তে সন্তান নিতু, যিশু ও মিশুর খোঁজ নিয়েছিলেন তিনি।
১৯৭৬ সালের ভয়াল ২১ জুলাইয়ের কথা স্মরণ করে তাহেরের স্ত্রী বলেন, ২১ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টায় মোহাম্মদপুরে তাহেরের বড় ভাই আরিফুর রহমানের বাসায় ছিলাম। কারাগার থেকে ফোন করে কর্নেল তাহেরের লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। উদ্বিগ্ন পরিবারের সদস্যরা জেল গেটে গিয়ে তার লাশ গ্রহণ করে। তবে আমাদের ইচ্ছা ছিল ঢাকার কোন জায়গায় কর্নেল তাহেরকে সমাধি করা হোক। সরকারের কাছে এ ইচ্ছা প্রকাশ করলে তারা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একটি এম্বুলেন্সে তাহেরের লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হলো। আর আমাদের একটি মাইক্রোবাসে পাঠিয়ে দেয়া হলো। নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার কাজলা গ্রামে বাড়ির ৩ মাইল দূরে শ্যামগঞ্জে লাশ ফেলে রেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা চলে যান। তখন গ্রামে কোন রাস্তা ছিল না। লাশের জন্য সরকার আলাদা কোন কফিনের ব্যবস্থা করেনি। কারাগারের চাদর দিয়ে ঢাকা অবস্থায় ৩ মাইল লাশ কাঁধে নিয়ে পারিবারিক গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এমনকি লাশ দাফনের ২১ দিন পর্যন্ত তাহেরের কবর পাহারা দেয়া হয়েছিল।
তাহেরকে আপাদমস্তক দৃঢ়চেতা সাহসী মানুষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কারণেই পরিবারের পক্ষ থেকে চাপ দেয়ার পরও রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী না হয়ে বরং উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘নিঃশঙ্কচিত্তের চেয়ে জীবনের মূল্যবান সম্পদ আর কিছু নেই। কোন অবস্থাতেই তিনি কারো কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হবেন না। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য পরিবার এমনকি তার মা আশরাফুন্নেসার পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তিনি একবারের জন্যও সে পথে পা বাড়াননি; বরং তিনি নিজের সাহসী সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন অকপটে। তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুতে বিন্দুমাত্র ভয় নেই, ইতিহাস একদিন তাকে মূল্যায়ন করবেই। আর এ কারণেই বিপ্লবী তাহের দৃঢ়তার সঙ্গে নিজ হাতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরে সারাবিশ্বে মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।