জিরো থেকে কয়েক হাজার কোটিপতি আসলামের ভয়ংকর উত্থান-মোসাদ কানেকশন-নেপথ্যে কে?
এস রহমান : জিরো থেকে হাজার কোটিপতি বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর ভয়ংকর উত্থানের নেপথ্যে জিয়া পরিষদ জড়িত। জিয়া পরিষদের হাত ধরেই আসলাম এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। আরও টাকার পাহাড় বানাতে সে হাত মেলায় মোসাদের সঙ্গে। প্লান করে সরকার উৎখাতের।
আসলামের এই মোসাদ কানেকশনের নেপথ্যে কে তা নিয়ে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। গোয়েন্দারা ইতিমধ্যে আসলামের মোসাদ কানেকশনের নেপথ্যে বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার যোগসাজশ খুঁজে পেয়েছেন।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর সঙ্গে সরকার উৎখাতে বৈঠককে ঘিরে এখন আলোচনার শীর্ষে বিএনপির নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। তার শিল্পপতি হয়ে ওঠার কাহিনীও বেশ চমকপ্রদ।
অল্প সময়ে বিএনপির মতো এটি বড় রাজনৈতিক দলের যুগ্ম মহাসচিবের মতো পদ বাগিয়ে নেয়া এই ‘কৌশলী’ রাজনীতিক এরই মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ব্যাংক ঋণই আছে তার ছয় হাজার কোটি টাকার ওপর।
আর এই বিপুল অংকের ব্যাংক ঋণের বেশিরভাগই আবার অনাদায়ী। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের রাজনীতি ম্যানেজ করে ভালোভাবেই সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন আসলাম চৌধুরী। শেষ পর্যন্ত মোসাদ ইস্যুতে তিনি এখন পুলিশের কব্জায়। রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকার কুড়িল থেকে গোযেন্দা পুলিশ আসলাম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের পর পরই তাকে রাজধানীর মিন্টোরেডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। আজ সোমবার তাকে আদালতে তোলা হবে।
গত শুক্রবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন আসলাম চৌধুরী। এ সময় বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং এটাকে বিএনপির বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও বলেছেন একই কথা। তিনি বলেন, “ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করলে তা প্রকাশ হওয়ার কথা নয়। এটি বানোয়াট তথ্য বলে আমাকে জানিয়েছে আসলাম চৌধুরী। তাকে ফাঁসানোর জন্য এ তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ”
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির একাধিক নেতার দাবি, আসলাম চৌধুরীর উত্থান সহ্য করতে পারছে না অনেকে। তাদের মধ্যে বিএনপির ঘরের লোকও রয়েছে। তাদের সহায়তায় সরকারের লোকজন আসলাম চৌধুরীকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নোংরা রাজনীতিতে নেমেছে।
সূত্র জানায়, খুব অল্প সময়ে আসলাম চৌধুরী বিএনপির শীর্ষপর্যায়ে উঠে আসেন। এর আগে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে হটিয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি হওয়ার পর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন আসলাম চৌধুরী। সেই থেকে আজপর্যন্ত এই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন তিনি।
কিন্তু সম্প্রতি বিএনপির নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হওয়ার পর তিনি মোসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন বলে মত প্রকাশ করেছেন বিএনপির চট্টগ্রাম মহানগরীর একাধিক শীর্ষ নেতা।
কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট এলাকার জলিল গ্রামের গোলাম হোসেন চৌধুরীর ছেলে আসলাম চৌধুরী। ২০০২ সালে জিয়া পরিষদের মাধ্যমে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তখন তিনি জিয়া পরিষদ, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির রাজনীতিতে আসেন।
এর দুই বছরের মাথায় জেলার সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন আসলাম চৌধুরী। পাশাপাশি জায়গা করে নেন কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে। পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছ থেকে কেড়ে নেন সভাপতির পদ। তার দুই বছর পর এখন দলের যুগ্ম মহাসচিবের মতো পদে আসীন হয়েছেন নানা সময়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত এ নেতা।
জানা গেছে, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরুর আগে বিএনপির এই নেতা বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে কলেজের শিক্ষকতায় যোগ দেন। এ সময় তিনি জামায়াতের সমর্থক ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানান বিএনপির কয়েকজন নেতা। তবে এর পক্ষে জোরালো কোনো সমর্থন ও প্রমাণ মেলেনি।
১৯৯৬ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি এফসিএ পাস করে একটি সিমেন্ট কোম্পানির হিসাব ব্যবস্থাপক পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে আরেকটি সিমেন্ট কোম্পানিতে সিএফও (হিসাব বিভাগের প্রধান) পদে কর্মরত ছিলেন। চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
এর মধ্যেই তিনি ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে আসলাম চৌধুরী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং শিল্পপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন।
আসলাম চৌধুরীর ব্যাংক ঋণ নেওয়ার কৌশলও বেশ চমকপ্রদ। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বেশ কয়েকটি রুগ্ণ শিল্প কেনেন আসলাম চৌধুরী। পরে সেগুলো চালু করার নামে দেশের একাধিক ব্যাংক থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেন, যার অধিকাংশ এখনো অনাদায়ী। এসব ব্যাংক ঋণ খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে এনবিআর।
অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েই অল্প সময়ের মধ্যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন আসলাম চৌধুরী। রাইজিং গ্রুপ নামে গড়ে তোলেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সীতাকুণ্ড ও দেশের বিভিন্ন স্থানে তার রয়েছে একাধিক সিএনজি ফিলিং স্টেশন। বোয়ালখালীতে আছে কনফিডেন্স সল্ট নামে একটি অত্যাধুনিক লবণ কারখানা।
নগরীর শাহআমানত সেতুর কাছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দখল করে গড়ে তোলেন স্বয়ংক্রিয় ইটভাটা। কক্সবাজারে রয়েছে বিপুল পরিমাণ জমিজমা। চকরিয়ার হারবাংয়ে অবস্থিত ইনানী রিসোর্ট-এর মালিকও তিনি। নগরের নাসিরাবাদ ও সাগরিকা সড়কে তার রয়েছে ফিশ প্রিজার্ভার্স নামে দুটি মৎস্য সংরক্ষণ কারখানা।
খুব অল্প সময়ে বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতা বনে যাওয়া আসলাম চৌধুরী ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চট্টগ্রামের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড উপজেলায় ধারাবাহিক সহিংসতার মূল মদদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব সহিংসতার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়।
নাশকতার একটি মামলায় প্রায় দেড় মাস জেল খেটে মাস দুয়েক আগে জামিনে বেরিয়ে আসেন তিনি। এর পূরস্কার হিসেবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন বলে বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মী আলাপকালে জানান।
এ সুবাধে ভারত সফরে গিয়ে তিনি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’কানেকশন গড়ে তোলেন। এর খবর ইসরায়েলভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম অনলাইন ডটকমও প্রকাশ করে। সেখানে ইহুদি কট্টরপন্থী দল লিকুদ পার্টির এক নেতার সঙ্গে বৈঠকের একাধিক ছবিও প্রকাশ করা হয়।
খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির প্রধান মেন্দি এন সাফাদি সম্প্রতি ভারত সফর করেন। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। নতুন সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে।
এ বৈঠক ফাঁস হয়ে গেলে দেশের গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “আমি ব্যবসায়িক কাজে ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে শিপন বাবুর সঙ্গে আমার পরিচয়।
তিনি আমাকে একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। যেখানে তেল আবিব-দিল্লি সম্পর্ক নিয়ে একটি সেমিনারের পর চা চক্রে গিয়েছিলাম এবং একটি গ্রুপ ছবিতে অংশ নিয়েছিলাম। ওই ছবি দিয়ে যে সংবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে তা ভিত্তিহীনভাবে আমাকে সরকার উৎখাতের ঘটনার সঙ্গে জড়ানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে।”
এদিকে আসলাম চৌধুরীর মোসাদ কানেকশন নিয়ে সরকারের অন্দরমহলে চলছে নানা বিশ্লেষণ। খোদ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, মোসাদকে ব্যবহার করে বিএনপি ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে সরকারের কাছে তথ্য-প্রমাণ রযেছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও তাকে খুঁজছেন। সরকার উৎখাতে এ নেতার সম্পৃক্ততার খবরে তোলপাড় চলছে খোদ বিএনপিতেও।