• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

জামায়াত শিবির রগ কাঁটা বাহিনী


প্রকাশিত: ৪:১৭ এএম, ৩১ জুলাই ২৪ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৫৮ বার

শফিক রহমান : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের পরই জামায়াত নিষিদ্ধে উদ্যোগ নেন। তিনি জানতেন জামায়াত হচ্ছে কাল শাপ। এরা একবার কোথাও মাথা ঢুকাতে পারলে তার সর্বনাশ করে ছাড়ে। এদের জন্মই যেনো আজন্ম পাপ ছিল। আর সে কারণে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সন্ত্রাসের ইতিহাস। জামায়াত শিবিবের আতুড় ঘর পাকিস্তানেও এরা নিষিদ্ধ হয়েছিল। আইয়ুব খানের সময় পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে। এই জামায়াতের ক্যাডার বাহিনী ছিল শিবির। একসময় এদের বলা হতো রগ কাটা বাহিনী। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গণে এদের কে বলা হতো রগ কাঁটা শিবির বাহিনী। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ছিল শিবিরের কথা মত কাজ না করলে এরা রাতের আধারে ধরে নিয়ে হাত পায়ের রগ কেটে দিতো।এদের নৃশংসতার বহু শিকার হয়েছে ছাত্রলীগ নেতারা।

একসময় রংপুরের কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এই জামায়াত শিবির বাহিনীর একচেটিয়া দাপট ছিল। কলেজ ছাত্রসংসদও দখলে নিয়েছিল শিবিরের কালাম বাহিনী। দখল বজায় রাখতে ওই সময় কলেজের প্রগতিশীল ছাত্রনেতাদের ধরে নিয়ে হাত পায়ের রগ কেটে দিয়েছিল এই কালামের বাহিনী। এর জলন্ত স্বাক্ষী ছাত্রনেতা রকিবুস সুলতান মানিক। জামায়াত শিবির মানিকের রাজনীতির সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে তার গাল কেটে দিয়েছিল। জামায়াত শিবিরের এই বাহিনী ক্ষুর বাহিনী নামেও পরিচিত হয়ে উঠেছিল রংপুর অঞ্চলে। এরা সন্ত্রাস করতে পকেটে দাড়ি কাটার ক্ষুর রাখত।

রংপুর অঞ্চলের দরিদ্রপিড়িত মানুষের সন্তানদের এরা খুঁজে এনে নিজেদের মেসে (রংপুরের বিশাল বাবু খাঁ’ এলাকায় ছিল বড় বড় শিবিরের মেস) রাখত। কথিত আছে রাতে মেসেই এদের ট্রেনিং হতো। থাকা খাওয়া পড়া লেখা সব ফ্রি ছিল-বিনিময়ে শিবিরের হয়ে সন্ত্রাস করতো এরা। রংপরে অঞ্চলে সাফল্য পেয়ে জামায়াত শিবির আস্তানা গাড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসী নেতা ছিল নাসির। হত্যা খুন গুম রগ কাটাসহ হেন কোনো অপকর্ম নাই যা এরা করত না। শিবির এর নাসির এর নামে বড় অংকের চাঁদা যেতো। ক্ষমতার পালা বদলে নাসির জেলে গেলে গিয়েও সেখান থেকে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করতো।

বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এসে রাজশাহী অঞ্চলে ‘বাংলা ভাই’ রাজত্ব শুরু করে। এই সেই বাংলা ভাই ছিল শিবিরের বড় নেতা। জামায়াত শিবিরের একটি অংশ শুরু জঙ্গি বাহিনী। নাম দেয় জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি। এই সেই বাংলা ভাই যিনি মুক্তিযোদ্ধাকে মেরে লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিল প্রকাশ্যে। অথচ তৎকালীন বিএনপি জামায়াত সরকার বলতো বাংলা ভাই নামে কোনো বাহিনী নাই। ক্ষমতার পালাবদলের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই জামায়াত শিবির জেএমবি বাংলা ভাইদের নির্মুল করে।

শিবিরের বলি ৩২ ছাত্রনেতা

বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের রগ কাটা, হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বরাবরই। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত ধর্মাশ্রয়ী এ ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছর পর থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে, যা চলছে এখনো। ছাত্রলীগের হিসাব মতে, ১৯৮১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গত ৩২ বছরে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ৩২ জন নেতাকর্মী ছাত্র শিবিরের হাতে নিহত হন। আহত হয়েছেন অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী।

ছাত্রলীগের দফতরে বিভিন্ন সময় শিবিরের হাতে নিহত ও আহত ছাত্র নেতাদের তালিকা সংরক্ষিত রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ছাত্র নেতাদের শিবির সরাসরি হত্যা করেছে কিংবা তাদের দোসরদের দিয়ে হত্যা করিয়েছে।ছাত্রলীগের দফতর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে হত্যা করে শিবির। এটি ছিল শিবিরের প্রথম হত্যা।

এরপর থেকে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালায় শিবির। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা মীর মোশতাক এলাহী।১৯৮৪ সালে শিবির চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও মেধাবী ছাত্র শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে। ১৯৮৬ সালে জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা আবদুল হামিদের হাতের কবজি কেটে নেয় শিবির ক্যাডারা।

১৯৮৮ সালে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী ছাত্রমৈত্রী নেতা ডাক্তার জামিল আক্তার রতনকে কুপিয়ে ও হাত পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ নেতা জালালকে হত্যা করে তারা।ওই বছরের ১৭ নভেম্বর শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসলাম হোসেন। এর পরদিনই শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজগর আলী।

ওই বছর ঘটেছে আরও কয়েকটি হত্যার ঘটনা। ১৭ জুলাই এসএম হলে বহিরাগত শিবির ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে জাসদ ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ সভাপতি ও সিনেট সদস্য আইয়ুব আলী খান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সিনেট সদস্য আহসানুল কবির বাদল ও হল সংসদের ভিপি নওশাদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়।একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. ইউনূসের বাসভবনেও বোমা হামলা চালানো হয়।

১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিন জনকে হত্যা করে সিলেটের রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে ছাত্রশিবির। এদিন শিবির ক্যাডাররা জাসদ ও ছাত্রলীগের মেধাবী নেতা মুনীর-ই-কিবরিয়া চৌধুরী, তপন জ্যোতি ও এনামুল হক জুয়েলকে হত্যা করে।১৯৮৯ সালের ১৮ এপ্রিল শিবিরের হামলায় মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শফিকুল ইসলাম। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর হত্যা করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রমৈত্রীর সহ সভাপতি ফারুকুজ্জামানকে।

১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ গুলি করে হত্যা করা হয় জাসদ ছাত্রলীগ কর্মী ইয়াসির আরাফাত। এ বছর শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে করা আন্দোলনে শিবির হামলা করে। এতে আহত হন জাসদ নেতা মুকিম। পাঁচদিন পর তিনি মারা যান।১৯৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খুন হন ছাত্রমৈত্রী নেতা জুবায়ের হোসেন রিমু। ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা প্রদ্যুৎ রুদ্র চৈতীর হাতের কব্জি কেটে নেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শিবিরের হাতে খুন হন ছাত্রমৈত্রীর আরেক নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য।১৯৯৭ সালে শিবিরের হামলা শিকার হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কর্মী বকুল।

১৯৯৮ সালে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা ছাত্র আইয়ুব আলী শিবিরের হাতে নিহত হন। ১৮ মে চট্রগ্রাম শহরতলির বটতলী এলাকায় শহরগামী শিক্ষকবাসে শিবিরের গুলিবর্ষণের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুসফিকুর সালেহীন নিহত হন।

একই বছর ২৪ মে সিলেটের ব্লু-বার্ড স্কুলের সামনে ছাত্রলীগ নেতা সৌমিত্র বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয় তলাপত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবছর।২০০০ সালে বহুল আলোচিত ৮ মার্ডারের ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামে। এ বছর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ৮ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা।

২০০১ সালে শিবিরের হাতে নিহত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা আলী মর্তুজা। এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে শিবির কর্মীরা কমান্ডো হামলা চালায়। এতে ছাত্রীদের লাঞ্ছিত ও রক্তাক্ত করে তারা।২০০৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের মিছিলে হামলা চালিয়ে শিবির ক্যাডাররা অর্ধশতাধিক ছাত্রীকে রক্তাক্ত করে। ওই বছর ৩১ আগস্ট শিবিরের হাতে নিহত হন সিলেট সরকারি ভেটেরিনারি কলেজের ছাত্র রফিকুল হক সোহাগ।

২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনকে হত্যা করে ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে রাখে শিবির কর্মীরা। ১২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এএএম মহিউদ্দিনকে শিবির ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

একই বছরের মার্চ মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বিনোদপুর বাজারে তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে কোপায় শিবির। এ ঘটনায় সোহরাওয়ার্দী হলের ৮ শিক্ষার্থী আহত হন। ১৯ অক্টোবর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী ইমরান আহমেদ কুপিয়ে আহত করা হয়। এ বছরের ২১ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি আখেরুজ্জামান তাকিমের ওপর হামলা চালায় শিবির।একই বছরের ২২ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম তৌহিদ আল হাসান তুহিনের ওপর হামলা চালিয়ে তার হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় শিবির কর্মীরা। এর পরের দিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ছাত্রলীগ কর্মী রুহুল আমিনের হাত ও পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়।

এ তালিকা প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের তৎকালীন দফতর সম্পাদক শেখ রাসেল বলেন, বিভিন্ন সময় এসব ঘটনা ঘটার পর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এ তালিকা শিবিরের অপকর্মের একটি খণ্ডিত অংশ মাত্র। শিবির এর চেয়ে আরও বেশি ভয়ঙ্কর।

শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করে ওই সময় ছাত্রলীগের সভাপতি বর্তমানে এমপি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেছিলেন, রাষ্ট্রের সব জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মূলে শিবির। দেখা যায়, যারা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, তারা অতীতে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা রাষ্ট্রীয় ও আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত। এদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।

সন্ত্রাস জিইয়ে রাখে জিয়া-

১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় জামায়াতে ইসলামী। এছাড়া দালাল আইনে বিচার শুরু হয় স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের। হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে প্রায় ৩৭ হাজার দণ্ডপ্রাপ্ত হন। এদের বড় অংশই ছিলো জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী। রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ হয়ে অস্তিত্বহারা হয়ে পড়ে জামায়াত নেতাকর্মীরা। আর দালাল আইনে দণ্ড হয় অসংখ্য নেতাকর্মীর। গ্রেপ্তার হয়ে জেলে ঢোকেন অনেকে। দণ্ড মাথায় পলাতক হয়ে যায় বহু। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের অস্তিত্ব কার্যত প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকে জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধীদের ফিরতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পরই দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে।

১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। আর এর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তখন মি. সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থাকলেও ক্ষমতার মূল চাবি ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে। আর এই সিদ্ধান্তের পরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রপট কয়েক দশকের জন্য অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর পুনরায় রাজনীতিতে ফিরে আসা। যে দল স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, সেই দলই কয়েক বছরের মধ্যে স্বাধীন দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরেছে এমন ঘটনা বিশ্বে আর নেই।

তবে তা ঘটেছিল বাংলাদেশে। সামরিক শাসকগোষ্ঠীর মদদ পেয়ে নিষিদ্ধ দল জামায়াতে ইসলামী শুধু যে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকারই পেয়েছিল তাই নয়, দলটির নেতারা, যারা পরে সরাসরি যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন, এমন বেশ কয়েকজন হয়েছিলেন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী।বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতায় নামে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (পরে ছাত্র শিবির)। আর জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামের বিভিন্ন হত্যাকারী বাহিনী। এসব বাহিনীর নেতৃত্বে থাকে জামায়াতের নেতারাই।

জামায়াতের এ অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতের রাজনীতি যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ হত্যা-সন্ত্রাসের রাজনীতি বন্ধ হবে না। এই কারণেই বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার ১৯৭২ সালে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে, সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দিলেন। সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেতনা সব মুছে ফেললেন এবং জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনপ্রতিষ্ঠিত করলেন।

জিয়াউর রহমানের সময় অনুমতি পাওয়ার পরই আগ্রাসীভাবে রাজনীতির ময়দানে নামেনি জামায়াত। বরং তারা নেয় কৌশলী ভূমিকা। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে। ১৯৭৬ সালে ২৪শে আগস্ট কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াত মিশে গঠন করে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল)। কারাগার থেকে বেরিয়ে নিষিদ্ধ জামায়াত নেতারা জড়ো হতে থাকেন এই আইডিএলের ঢালে। আত্মগোপন থেকে জড়ো হতে থাকেন অনেকে।আর এই অবস্থার মধ্যে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আইডিএলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয় বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতা। সেই নির্বাচনে ছয়জন জামায়াত নেতা ভোটে জিতে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে যান।

এরপরই স্বাধীন বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে জামায়াত। ওই বছরেই (১৯৭৯) ঢাকায় একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেই কনভেনশনে গোলাম আযমের ভাষণ পড়ে শোনানো হয়। সেখানেই অনুমোদন দেয়া হয় নতুন গঠনতন্ত্র। এরপরই চার দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে পড়ে জামায়াতে ইসলামী। শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘জামায়াতে ইসলাম এই অঞ্চলে ১৯৫৪ সালে রাজনীতি শুরু করে এবং জিয়াউর রহমান তাদেরকে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।এই গবেষক মনে করেন, জিয়াউর রহমানের সময় আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলাম প্রথমে আইডিএলের ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এরপরই ১৯৭৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা জালালকে হত্যার মাধ্যমে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে তারা। সেই থেকে এখন পর্যন্ত জামায়াত হত্যা-সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। যখনই সুযোগ পেয়েছে- ছাত্র, নিরীহ নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে তারা।শাহরিয়ার কবির বলেন, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরও হত্যা করেছে। যখনই সুযোগ পেয়েছে তারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার পর দাপটের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত জামায়াত নেতারা। তারা সংসদ সদস্য হয়েছে, হয়েছেন মন্ত্রী। বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে জামায়াত নেতারা গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। সেখানে পুনর্বাসিত করা হয় ছাত্র শিবিরসহ সমমনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক সহকর্মীদের। আর সঙ্গে চলে হত্যাকাণ্ডসহ সন্ত্রাসের রাজত্ব।

শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতের রাজনীতিটাকে আবার পুনপ্রতিষ্ঠিত করেছে বিএনপি। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের মধ্যে জামায়াতের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। মানুষ ভুলে যায়নি যে, ১৯৭১ সালে জামায়াত কী করেছিল। তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বহুবার বলেছেন যে, জামায়াত-বিএনপি একই মায়ের সন্তান, ছাত্র শিবির-ছাত্রদল একই মায়ের সন্তান।বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমলে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়া জামায়াত আরেক সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের সময়ও সংসদে আসন পায়। ১৯৮৬ সালে ১০টি আসন পায়।

তবে জামায়াত ফুলে ফেঁপে ওঠে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে তারা ১৩ শতাংশ ভোট পায় এবং ১৮টি সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয়। সে সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সরকার গঠনে সমর্থন দেয় জামায়াতে ইসলামী। আর এই সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম কলঙ্কিত ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতারা পর পাকিস্তানে পলাতক থাকা জামায়াতের শীর্ষনেতা মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযম ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর আমিরের দায়িত্ব নেন, যদিও তিনি দেশে ফেরেন তার আগেই, সামরিক শাসনের সময়।

পরের নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে তখন দাপট হারিয়ে ফেলে স্বাধীনতা বিরোধী দলটি। মাত্র আট শতাংশ ভোট পেয়ে তিনটি সংসদীয় আসনে জয় পায়। তবে পরিস্থিতি আবার ঘুরে যায় ২০০১ সালের নির্বাচনে। এবার বিএনপির সঙ্গে সরাসরি জোট বেঁধে ভোটে নামে দলটি। পুনরায় মোটাতাজা হয়ে ওঠে জামায়াত নেতারা। বিএনপির জোটসঙ্গী হয়ে সেবার ১৭টি আসন পায় জামায়াত।

খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী বানানো হয়। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই দুই জনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে তাদের ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধে বিএনপি। কিন্তু এই নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারে না। মাত্র দুইটি আসন পায়। এরপর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানোর পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি জামায়াত।

রাজনীতির শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সন্ত্রাসের ইতিহাস। আইয়ুব খানের সময় পাকিস্তানেও নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। তাদের মধ্যে রয়েছেন দলটির সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, নায়েবে আমির আব্দুস সোবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, মো. কামরুজ্জামান, শুরা সদস্য মীর কাসেম আলী।মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের আমিরের দায়িত্বে থাকা গোলাম আযম এবং নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দুজনেই কারাগারে মারা গেছেন।

লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াত যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই সন্ত্রাস-নাশকতা করেছে। ২০১৩ সালে আমরা দেখলাম, হেফাজতে ইসলাম ও মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এই জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা একইভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার চক্রান্ত করেছিলো।তাই আমরা বলছি, এখন সময় এসেছে জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসের জন্য নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইন আছে, বলেন তিনি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দলের সরাসরি সংযোগ প্রমাণিত, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক; কোনো ধরনের অধিকারই থাকা উচিত না। যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ, সেই চেতনার সরাসরি বিরোধীতাকারী, স্পষ্টভাবে চিহ্নিত একটি রাজনৈতিক দল কোনোমতেই রাজনৈতিক বৈধতা পেতে পারে না। আর অর্থনৈতিক বৈধতারতো প্রশ্নই জাগে না,’ বলেন তিনি।