• বৃহস্পতিবার , ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

জল্লাদ শাহজাহানের করুণ আর্তনাদ-প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয় প্রার্থনা


প্রকাশিত: ১০:০৪ পিএম, ১৮ জুন ২৩ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৬১ বার


লাবণ্য চৌধুরী : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জল্লাদ হিসেবে ৩ দশকেরও বেশী সময়ে ২৬ জন অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা শাহজাহান এখন নিঃস্ব রিক্ত। ওকে দেখার মত এখন কেউ নেই। নিরুপায় জল্লাদ শাহজাহান প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকার প্রার্থনা করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য’র উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, কেউ আশ্রয়হীন ঠিকানাহীন থাকবে না বাংলাদেশে; কাজেই আমাকেও একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। প্রায় ৩২ বছর কারাভোগের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। কারাগারের প্রধান জল্লাদ হিসেবে ৩ দশকে একে একে ২৬ জন অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করেছেন তিনি।

এই তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি বজলুল হুদা ও শাহরিয়ার রশিদের নাম। আরও আছেন সাকা চৌধুরী, এরশাদ শিকদার ও বাংলা ভাইয়ের মতো অপরাধীরা। গতকাল রবিবার ১৮ জুন দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ফাঁসি কার্যকরের আগে শাহজাহানের নিজের মানসিক অবস্থার কথা জানতে চেয়েছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। জবাবে তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে দণ্ডিত মানুষগুলোর জন্য মায়া লাগলেও আইনের খাতিরেই তাকে কাজটি করতে হয়েছে।

শাহজাহান বলেন, দীর্ঘদিন জেল খেটেছি। জেলে সার্ভিস দিয়েছি। কারাগারে ছিলাম। আমাকে কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট আদর করেছে, সম্মান করেছে। আমি ভালোই ছিলাম।ফটক থেকে বের হয়ে আসার সময় শাহজাহানের পরনে ছিল সাদা পোশাক, হাতে একটি ব্যাগ।শাহজাহান গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তার বক্তব্যে উঠে আসে গত ৩২ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসের কিছু আলোচিত অপরাধ ও অপরাধীদের নাম।ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জল্লাদ হিসেবে ৩ দশকেরও বেশ সময়ে ২৬ জন অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করেছেন শাহজাহান।যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি, জেএমবির সদস্য, এরশাদ শিকদার ও মুনীরের (মুনীর-খুকু হত্যা মামলার আসামি) মতো বড় বড় অপরাধীকে ফাঁসি দেওয়ার কথা জানান তিনি।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেওয়া নিয়ে তার অনুভূতি সম্পর্কে শাহজাহান বলেন, যুদ্ধের একটি অংশের সঙ্গে থাকতে পেরে তিনি সন্তুষ্ট। তিনি জানান, যখন তিনি কারাগারের বাইরে ছিলেন, তখন স্বাধীনতা সংগ্রাম নিজের চোখে দেখেছেন।যদি তারা সে অপরাধ করে থাকে…আমি তো আর তাদের মনের খবর বলতে পারব না, যেহেতু তারা দোষী হয়েছে, অপরাধ করেছে, সে হিসাবে তো আমার খারাপ লাগার কথা না, যোগ করেন তিনি।

শাহজাহান বলেন, আমার অতীত অতটা ভালো ছিল না। আমি অপরাধ করেছি, জেল খেটেছি।তিনি বলেন, আমি অন্যের বাড়িতে উঠছি এখন। তাহলে আমি কী করে খাব? কোথায় যাব কী করব? এখন তো আর আমার সেই বয়স নেই। আমার বয়স ৭৪। আমি এখন কী করব? আমার একটাই কথা আপনাদের কাছে, আপনারা যদি একটু সাহায্য করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটাই অনুরোধ। আমাকে যেন বাড়ি-ঘর দিয়ে, আমাকে চলার মতো কিছু করে দেন। এটাই আমার অনুরোধ।

আমি জানি আমার একটা বোন আছে, ভাগিনা আছে কিন্তু জেলে আসার পর থেকে তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। ফোনে ২-১ বার কথা হয়েছে কিন্তু তারা আসেনি। বোনের সঙ্গে আমার কখনো (কারাদণ্ডের পর) দেখাও হয়নি,বলেন তিনি।
শাহজাহান আরও বলেন, যারা আমার সঙ্গে মুক্তি পেয়েছে, তাদের সঙ্গে কারাগারে আমি ভালো ব্যবহার করেছি, তারাও আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে। তাদের সঙ্গেই এখন যাচ্ছি, যেতে বাধ্য হচ্ছি।

কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন কি না জানতে চাইলে শাহজাহান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, এখানে নিরাপত্তার বিষয়টা ভিন্ন। আমার হুকুমে তো ফাঁসি হয়নি। যারা রাষ্ট্রের দায়িত্বে আছে, তাদের হুকুমে ফাঁসি দিয়েছি। আসামিরা প্রেসিডেন্টের ক্ষমা ভিক্ষা করেও ব্যর্থ হওয়ার পরেই আমার কাছে এসেছে।

তার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, প্রতিটি ফাঁসিতেই কিছু আবেগ জড়িত। কারণ আমার হাত দিয়ে একটা লোক যাচ্ছে। একটা মানুষ যত অপরাধই করুক, তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে দেখলে সবারই মায়া হয়। কিন্তু আমি মায়া করলেও তো আদালত বা আইন তো মায়া করবে না। আমি চলে আসার পরও অপরাধীদের ফাঁসি হবে। মায়া লাগলেও আইনের খাতিরে আমাকে কাজটা করতে হয়েছে। আমি নিজে কনভিক্টেড, সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলাম দেখেই আমাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

এরপর বড় বড় অপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ার স্মৃতিচারণ করেন তিনি। শাহজাহান জানান, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার ফাঁসির আগে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু একটি কথাই বলেছিলেন—আমার জীবনে আমি কখনো কোনো অপরাধ করিনি, আমার জন্য দোয়া করবেন। বাংলা ভাই নামে পরিচিত জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম অনুরোধ করেছিলেন তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরে যেন ছবি তোলা না হয়।

শাহজাহান আরও জানান, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা একেবারেই চুপচাপ ছিলেন। তারা কোনো কথাই বলেননি। ফাঁসি দেওয়ার আগে মুনীর বলেছিলেন, আমাকে একটা সিগারেট দাও।এক সাংবাদিকের প্রশ্ন করেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে (সাকা চৌধুরী) আমরা খুব উশৃঙ্খল আচরণ করতে দেখেছি। সংসদে, আদালতে, এমনকি কারাগারেও তিনি এ ধরনের আচরণ করতেন বলে জানা গেছে। ফাঁসির দিন কি তিনি একই রকম আচরণ করেছেন?

শাহজাহান বলেন, ওইসময় তিনি চুপচাপই ছিলেন। একটা মানুষ যত উশৃঙ্খলই হোক না কেন, সে যখন জানতে পারে যে সে আজ দুনিয়া থেকে চলে যাবে, তখন তার মুখ দিয়ে আর কোনো খারাপ কথা আসে না।কারাবাসের দিনগুলোতে তিনি সবার সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করেছেন, উশৃঙ্খল আচরণ করেছেন কিন্তু ফাঁসির দিন এ রকম কিছু করেননি, জানান শাহজাহান।সরকারের কাছে কী চান এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তাকে যেন প্রধানমন্ত্রী বাকি জীবন থাকা-খাওয়া ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়—এটাই তার একমাত্র চাওয়া।