জলি কাহিনী’র নয়া মোড়-গলায় ছুরি ধরেছিল আমার বাবা:আয়মান
বিশেষ প্রতিনিধি : অবশেষে মায়ের ‘আত্মহত্যা’ বিষয়ে মুখ খুললো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহান জলির ছেলে আয়মান সোয়াদ আহমেদ। ‘সুইসাইড নোট’ লিখে মায়ের আত্মহত্যার ১৭ দিন পর সোমবার রাতে নিজের ফেসবুকে নবম শ্রেণীর এ ছাত্র আবেগঘন পোস্ট দেয়।এতে সোয়াদ সুইসাইড নোটে মায়ের লিখে যাওয়া কথার সত্যতা নিশ্চিত করে নিজের গলায় বাবা সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমদের ছুরি ধরার কথা উল্লেখ করেছে। ফলে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকায় নানা বাড়িতে অবস্থান করা সোয়াদ ঘটনার পর থেকে চুপ ছিল। তবে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পর যারা এতদিন তানভীর আহমদের পক্ষ নিয়েছিলেন, তারাও ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করে ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সোয়াদ লিখেছে, ‘অনেক দিন ধরেই আমার কাছে ‘গলায় ছুরি ধরার ঘটনাটা জানতে চাওয়া হচ্ছে। আজকে বলেই দেই, কি ঘটেছিল ওইদিন।’
সোয়াদ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে এভাবে, ‘আম্মা আর আমি বাইরে যেতে চেয়েছিলাম, আমার এক বান্ধবীর বাসায়। সারা দিন প্ল্যানিং করার পর আমি আব্বার কাছে অনুমতি চাইতে গেলাম। অনুমতি চাওয়ার সময় আব্বা বলে, তোমার আম্মাকে বলো ওর মত চলে যেতে। আমি তোমাকে দিয়ে আসবো। আমি বললাম- আজব তো। আমি আর মা এক জিনিস প্লান করছি, তুমি কেন ইন্টারফেয়ার করছো? আব্বা বলল- বাপ হিসেবে আমার এ অধিকার আছে।’
নবম শ্রেণী পডুয়া সোয়াদ আরও লিখেছে, ‘আমি আব্বাকে বলি, কিন্তু আম্মার সঙ্গে প্লানটা নষ্ট করার অধিকারও তোমার নাই। আব্বা বলে, মেইন থিং ইজ… (মূল বিষয় হল) তোমাকে ওই নারী সঙ্গে যেতে দেব না। গেলে আমার সঙ্গে যাবা, না হলে নাই। আমি বলি- কি এমন করছে যে, এত ক্ষতিকর মনে কর আম্মাকে? হ্যাঁ? আব্বা কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে যায়।’
‘পরে বাধ্য হয়ে আম্মাকে ফোন দিয়ে বলি, আমি যেতে পারব না আজকে। মা বলে- আমি বুঝছি কি হয়েছে। চিন্তা করিস না বাবা। আর কয়েকটা দিন। পরে সন্ধ্যায় আব্বাকে বলি, প্লানটা নষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ। তখনি আব্বা বলে উঠে- তুই কি ঝগড়া লাগাইতে চাস? তোর আম্মার মত হয়েছিস। আমি বলি- আমার আম্মার নামে এই সব কথা বলবা না, খবরদার! আব্বা বলে- তোর মায়ের সঙ্গে কথা বন্ধ কর, এই কথাগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। আমি বলি- বন্ধ করব না!’
সোয়াদের ভাষ্যে, ‘আব্বা তখনি রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় চাকু নিয়ে এসে আমার গলায় ধরে বলে- কি বললি? শুনতে পাইনি। বললাম (অল্প স্বরে)- বন্ধ করবো না। মেরে ফেলতে চাইলে মারো। আম্মাকে তো আমার সামনে মারার চেষ্টা করেছো। সিউরলি এটাও পারবে। তখন আব্বা চাকুটা ছুড়ে মাটিতে ফেলে দিলো এবং কিছু না বলে চলে যায় ঘরে…।’
ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে মোবাইলে সোয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সে এটি তার আইডি এবং পোস্টের সত্যত্যা নিশ্চিত করে।
এদিকে সোয়াদের দেয়া পোস্টের নিচে কমেন্টে বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন গত ২২ তারিখে বিভাগের একাডেমিক সভায় তানভীরের পক্ষ নেয়ায় নিজে লজ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি সোয়াদকে সান্ত্বনা দিয়ে সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমদের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং তাকে ফেসবুকে আনফ্রেন্ড করার কথা উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন সোয়াদকে সত্য প্রকাশের জন্য বাহবা এবং সহানুভূতি জানিয়ে মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে তারা তানভীরের দিকে তীর্যক মন্তব্য ছুড়েছেন। তবে ছেলের ফেসবুক পোস্ট বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে স্ত্রী শিক্ষিকা জলির মৃত্যুর দিন রাতে ফেসবুকে তানভীর আহমদ ছেলের গলায় ছুরি ধরার বিষয়ে লেখেন, ‘যে ছেলেকে এতদিন ধরে একা আদর যত্ন দিয়ে বড় করলাম, তার ব্যাপারে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো।’পরদিন ফেসবুকে আবারও একটি পোস্ট দেন তানভীর আহমদ। সেখানে তিনি তাদের প্রায় চার বছর আগে বিচ্ছেদ এবং যোগাযোগ না থাকার কথা উল্লেখ করেন।
সোয়াদের ফেসবুক পোস্ট
একইসঙ্গে তার সাবেক স্ত্রী আকতার জাহান জলি বিভাগের জুনিয়র এক সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন বলে দাবি করেন।তবে ফেসবুকে ওই পোস্ট দেয়ার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পরদিন তা মুছে দেন তানভীর আহমদ। উল্লেখ্য, গত ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি ভবনে নিজ কক্ষ থেকে আকতার জাহান জলির লাশ উদ্ধার করা হয়।
সে সময় ওই কক্ষে জলির নিজ হাতে লেখা সুইসাইড নোট পাওয়া যায়। তাতে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম। সোয়াদকে (সন্তান) যেন ওর বাবা (তানভীর আহমেদ) কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে, সে যে কোনো সময় সন্তানকে মেরে ফেলতে বা মরতে বাধ্য করতে পারে।’
:ঘটনার পরদিন ময়নাতদন্তের পর আকতার জাহানের ছোট ভাই কামরুল হাসান রতন আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগে নগরীর মতিহার থানায় অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
এদিকে প্ররোচণাকারীকে খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার ১৭ দিন পেরিয়ে গেলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, মামলাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে কার্যত কোনো উন্নতি দৃশ্যমান হয়নি।
সহকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদের কথা পুলিশ দাবি করলেও বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এখনও সেভাবে কোনো সহকর্মীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়নি।এ নিয়ে শিক্ষিকা জলির পরিবার, সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিহার থানার উপপরিদর্শক ব্রজ গোপাল বলেন, ‘মামলাটি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। আমি তদন্তে থাকলেও একজন সহকারী কমিশনার এবং একজন উপকমিশনার পদ মর্যাদার কর্মকর্তা সার্বিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। আশা করছি, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত অভিযোগপত্র দেয়া সম্ভব হবে।’
নগরীর মতিহার থানা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) একরামুল হক বলেন, ভিসেরা নমুনার পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদন হাতে না আসা পর্যন্ত সেভাবে তদন্তের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানানো সম্ভব হচ্ছে না।