জঙ্গিবাদের ভয়ংকর থাবা-এসপি বাবুলের স্ত্রীর পর কে?
সাইফুল বারী মাসুম : ৪৫ লাশ ৬৬ টি হামলার পরও নির্মুল হচ্ছে না জঙ্গিবাদের ভয়ংকর থাবা? চেলারা।জঙ্গিদের একের পর কিলিং মিশন সনাক্ত করতে বা হাতেনাতে ধরতে পুলিশ ব্যর্থ হচ্ছে।ফলে জঙ্গিরা পার পেয়ে পুনরায় অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ মাসে ৪৫টি জঙ্গি হামলার ঘটনায় মুক্তমনা লেখক, ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিদেশী নাগরিক ও পুলিশ সদস্যসহ খুন হয়েছেন ৪৭ জন। সর্বশেষ রোববার চট্টগ্রামে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতা। কোনো পুলিশ কর্মকর্তার পরিবারের ওপর হামলার ঘটনা প্রথম এটিই । এর আগে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর ৬৬টি হামলার ঘটনা ঘটেছিল।
আইনশৃংখলা বাহিনী ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭৯টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৬২টি। আর বিচারাধীন আছে ৫৭টি ও তদন্ত পর্যায়ে আছে ২৬০টি। তদন্ত আর বিচারের এ দীর্ঘসূত্রতাকে পুঁজি করে গ্রেফতারের পরও জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে দুই শতাধিক জঙ্গি।
যাতে সিরিয়ায় আইএস কি করছে, তারা কোথায় সফল হয়েছে সেগুলো দ্রুত ওইসব পেজে চলে আসছে। ফলে তরুণরা এসবের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আমাদের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘র্যাব গঠন করা হয়েছিল জঙ্গিবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য। কিন্তু তারা এখন যানজট নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে আবার মোবাইল কোর্টসহ অন্যান্য কাজ করছে। ফলে তাদের যে মূল কাজ সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ শুরুর দিকে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় র্যাব বেশ সফলতার পরিচয় দিয়েছিল।
অভিযোগ করা হয়েছে, আইনশৃংখলা বাহিনীর সক্ষমতার অভাবের কারণেই জঙ্গি দমনে গৃহীত পদক্ষেপে কার্যকরী ফল আসছে না। সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও নিষ্ঠার অভাব রয়েছে। পাশাপাশি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত ও বিচার কাজের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও জঙ্গিরা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এসব মামলার বিচার দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হলে এবং দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে তাদের ওপর একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হতো।
ভুক্তেভোগীরা বলেন, দেশে দৃশ্যমান কিছু কিলিং সেল আছে। সেগুলোর অস্তিত্ব গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। শুধু আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা বাড়ালেই হবে না জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় রাজনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় চলমান পদক্ষেপের পাশাপাশি সব বাহিনী সমন্বয়ে সারা দেশে একটি ‘চিরুনি অভিযান’ পরিচালনা করতে আশাতীত ফল হতে পারে। পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন- ‘এসব টার্গেট কিলিং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। আমরা হাতেনাতে দেখিয়ে দিয়েছি কারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। আমরা অতীতে প্রতিটি ঘটনার মূলোৎপাটন করেছি।’ তিনি বলেন ‘এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করছে জঙ্গিরা। সৎ ও সাহসী পুলিশ অফিসারদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য বাবুল আক্তারের স্ত্রীর ওপর কাপুরুষোচিত ও বর্বর হামলা চালানো হয়েছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, ‘ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের পর থেকে উগ্রবাদীদের হত্যায় নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে। জিহাদের নামে অরক্ষিত ও নীরিহ ব্যক্তিদের ওপর হামলা করে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডের পর আইএস বা আল কায়দা দায় স্বীকার করছে।
বাংলাদেশে কিছু জঙ্গি হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। স্বাধীনতা বিরোধীরা এসব অপশক্তিকে ব্যবহার করছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। এদের নিয়ন্ত্রণে ফলদায়ক কিছু না হলে নীরিহ মানুষের মধ্যে আতংক ও ভীতির সৃষ্টি হবে এবং জঙ্গিবাদ যে বাংলাদেশে আছে সেটি প্রমাণ করার একটি সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস বা আল কায়দা আছে কিনা সেটা নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেই বিতর্ককে একটি সুরাহা করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ জঙ্গি আছে এবং এদের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা আছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে।’
টার্গেট কিলিংয়ের পেছনে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা আছে উল্লেখ করে এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, বাংলাদেশ সরকার তাদের লক্ষ্য। এ সরকারের অসাম্প্রদায়িক নীতি জঙ্গিবাদের পক্ষে যায় না। আইএস তাদের পত্রিকায় সর্বশেষ যে লেখাটা দিয়েছে সেখানে তারা বাংলাদেশের সরকারকে বলেছে ‘মুরতাদ’। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে।
এখানে তাদের বহুমুখী লক্ষ্য আছে বলে মনে হয়। আবার সংখ্যালঘুরা আক্রামণের লক্ষ্য হচ্ছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এটাকে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করছে। তারা (গোয়েন্দারা) বলছে, বাংলাদেশ হচ্ছে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সরকার। স্বভাবতই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি সমীকরণ করার চেষ্টা চলছে।
আবদুর রশীদ আরও বলেন, ‘জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আমাদের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যে কৌশল অনুসরণ করছে আমার মনে হচ্ছে এ কৌশল ফলদায়ক নয়। এটি কাজে দিচ্ছে না। ফলে স্বভাবতই এ কৌশল পরিবর্তন করা দরকার। জঙ্গিবিরোধী কাজে অনেক ধরনের কৌশল আছে। যেসব কৌশলে এ ধরনের গুপ্তহত্যা বা টার্গেট কিলিং বন্ধ করতে সমর্থ হয়। কৌশল নতুনভাবে দেখতে হবে এবং কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে।