জঙ্গিদের ওস্তাদ ছিল ‘বাংলার বাঘ’-তাকে ধরতে রেডএ্যালার্ট
বিশেষ প্রতিনিধি : গুলশানের হলি আর্টিসানের আত্মঘাতি জঙ্গিদের ওস্তাদ ছিল ‘বাংলার বাঘ’। এই বাংলার বাঘের নিখুঁত ছকে গুলশানের হলি আর্টিসান ট্রাজেডি ঘটেছে। কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরে সে-? এই ‘বাংলার বাঘ’ কে ধরতে রেডএ্যালার্টে সব গোয়েন্দারা।এই চক্রের সহযোগী ৮ আত্মঘাতী গোয়েন্দা নজরদারিতে।
গুলশান হামলা পরিকল্পনার মূল ঘাঁটি ছিল রাজধানীর ভাটারা থানাধীন অভিজাত আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাট। এ হামলার সহযোগী হিসেবে ৮ জঙ্গিকে নজরদারিতে আনার পর সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২টি মেশিনগান। উদঘাটিত হয়েছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। নির্দেশদাতার নামও জানা গেছে । বাংলার বাঘ যার ছদ্মনাম। যিনি বরখাস্ত হওয়া সেই মেজর জিয়ারও বস।
আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা চিরুনি অভিযান চালিয়ে সম্ভাব্য স্থানগুলোতে খুঁজছে। ওদিকে নজরদারিতে থাকা তরুণরা নিষিদ্ধ সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য। এদের মধ্যে কম্পিউটার প্রকৌশলী ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রয়েছে। আÍঘাতী জঙ্গিরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে ব্যবহার করছে অমুসলিম নাম। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে থ্রিমাসহ কয়েকটি বিশেষ অ্যাপসকে বেছে নিয়েছে। এসব অ্যাপসেও তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করে।
গুলশানে কিলিং মিশন বাস্তবায়নের জন্য হামলার তিন মাস আগে রাজধানীর ভাটারা থানার একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া করে জঙ্গিরা। ওই বাসা থেকে পরিচালিত হয় গুলশানে হলি আর্টিজান কিলিং মিশন। নজরদারিতে থাকা জঙ্গি সূত্রগুলো দাবি করছে, এই ফ্ল্যাটই তাদের সদর দফতর। মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, জঙ্গিদের মূল আস্তানার ঠিকানা নিশ্চিত হয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সম্প্রতি ফ্ল্যাটটিতে অভিযান চালায়। কিন্তু ফ্ল্যাটে তল্লাশিকালে এক পর্যায়ে পেয়ে যান দুটি একে-২২ রাইফেল।স্বয়ংক্রিয় এসব অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করা সম্ভব। এ অস্ত্রের দুটি ম্যাগাজিন ব্যবহার করে একসঙ্গে ৭৮ রাউন্ড পর্যন্ত গুলি করা যায়, যা ব্রাশফায়ার নামে পরিচিত। মামলার এজাহারে অত্যাধুনিক এই রাইফেলকে মেশিনগান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সূত্র মতে জানা গেছে, উদ্ধারকৃত এই অস্ত্র এসেছে ভারতের বিহার রাজ্য থেকে। বিহারের অস্ত্র কারখানাটি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের নির্মিত বলেও অস্ত্রের গায়ে খোদাই করে দেয়। বর্তমানে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কাছে (এবিটি) এরকম কমপক্ষে ১২টি ও জেএমবির কাছে ৬টি একে-২২ মেশিনগান আছে। এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু ক্ষুদ্র অস্ত্র।
জঙ্গিদের হাতে থাকা পুরো অস্ত্রভাণ্ডার উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ছদ্মবেশী আত্মঘাতীরা বিভ্রান্তকর তথ্য দেয়ায় এসব অস্ত্রভাণ্ডারের সঠিক খোঁজ মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ভারতের বিহার থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আনা হয়। চট্টগ্রাম থেকে এসব অস্ত্র আসে রাজধানীতে। বিহারের ওই অস্ত্র কারখানা থেকে প্রতিটি একে-২২ বোরের মেশিনগান কিনতে জঙ্গিদের খরচ পড়ে ৯০ হাজার টাকা। অথচ আমেরিকা বা রাশিয়ার তৈরি এ রকম একটি অস্ত্রের দাম ৪ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভাটারা ফ্ল্যাট থেকেই নিরবাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ১ জুলাই সন্ধ্যায় হেঁটে হলি আর্টিজানে যান। তল্লাশি এড়াতে কৌশল হিসেবে বেছে নেয় ইফতার-পরবর্তী সময়কে। তাদের মধ্যে দু’জন নর্দা কালাচাঁদপুর হয়ে ইউনাইটেডের পাশ দিয়ে এবং দু’জন নতুন বাজার হয়ে এবং পরে একজন নর্দা হয়ে হলি আর্টিজানে যায়।
গুলশান হামলায় নিহত ৫ জঙ্গির মধ্যে নিরবাস ইসলাম ঝিনাইদহ থেকে ভাটারার ওই আস্তানায় এসে গুলশান হামলায় যোগ দেয়। এর আগে সে তিন মাস ধরে ঝিনাইদহের সোনালীপাড়া এলাকায় একটি মেসে তার আরও ছয় সহযোগীকে নিয়ে অবস্থান করে। ওই সময় তারা ঝিনাইদহে বেশ কয়েকটি জঙ্গি অপারেশন করে। অথচ নিবরাস ইসলামের বাসা ঢাকার উত্তরায়। সে নর্থ সাউথ ও মালয়েশিয়াস্থ মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তার বাবা নজরুল ইসলাম একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী।
এদিকে গুলশান হামলার তদন্তে ইতিমধ্যে বড় ধরনের সাফল্য ধরা দিয়েছে। এই হামলা পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত জেএমবির ৮ আত্মঘাতীকে নজরদারির মধ্যে আনতে সক্ষম হয়েছে। তাদের গ্রেফতার করতে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বগুড়া ও চট্টগ্রামে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতারের খবর আসতে পারে।
সূত্র জানায়, এসব আত্মঘাতীর মধ্যে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথসহ একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বেশ কয়েকজন ছাত্র রয়েছে।
অপরদিকে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় বড় অগ্রগতি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে একজনকে নজরদারির জালে আটকে ফেলা সম্ভব হয়েছে।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া জেএমবি সদস্যরা পুলিশকে জানিয়েছে, নেতার সামনে নেয়ার আগে তাদের এক ধরনের বিশেষ সানগ্লাস পরিয়ে নেয়া হয়। যে কারণে তারা নেতার চেহারা দেখতে পারেন না। ‘বাংলার বাঘ’ ছদ্মনামের ওই ব্যক্তি বরখাস্ত হওয়া সেই মেজর জিয়ারও বস। অবশ্য মেজর জিয়া আগেই নজরদারির মধ্যে চলে এসেছেন বলে জানা গেছে।
১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট নামে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় ইতালির ৯ জন, জাপানের ৭ জন, ভারতের একজন ও বাংলাদেশের ৩ জন জিম্মি নিহত হয়। এ ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জন নিহত হন।