• শনিবার , ১৬ নভেম্বর ২০২৪

চালের ট্রাকে চাঁদাবাজির ১৩ কোটি টাকা পুলিশের পেটে


প্রকাশিত: ১:৩৫ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৭ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪৫ বার

chal chada-www.jatirkhantha.com.bd

উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি :  সাম্প্রতিককালে চালবোঝাই ট্র্রাকে চাঁদাবাজির উৎপাত বেড়ে গেছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার চালকল মালিকরা বলছেন, উত্তরবঙ্গের চাঁপাই নবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া থেকে ছেড়ে যাওয়া চালবোঝাই ট্রাক বিভিন্ন পয়েন্টে আটকে টাকা নিচ্ছে পুলিশ। উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকা ও ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছতে ট্রাক প্রতি চাঁদা দিতে হচ্ছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত।

চালকল মালিক, ট্রাক-মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চল থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫ শ’ ট্রাক চাল পৌঁছে দেয় ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ট্রাকপ্রতি গড়ে ৯ হাজার টাকা ধরলে দিনে অন্তত ৪৫ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয় পুলিশকে। এভাবে মাসে কম করে হলেও ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা চাঁদা গুনতে হচ্ছে তাদের। তারা আরও জানান, চাঁদা না দিলে হয়রানির শেষ থাকে না। শেষতক এই চাপ গিয়ে পড়ে ভোক্তাদের ওপর। চালের দাম বাড়ে। বাড়তি দামেই ভোক্তাদের চাল কিনতে হয়।

ঢাকা মহানগরী ও আশপাশের এলাকায়ও চালের ট্রাক আটকে পুলিশ টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। চালকল মালিকরা আরও বলছেন, চালের ট্রাকে চাঁদাবাজির কারণেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় চালের দাম বাড়ছে। সড়কে দেয়া চাঁদার টাকা চালকল মালিকদেরই পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে তারা চালের দামও বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশের (বগুড়া) পুলিশ সুপার (এসপি) ইসরাফিল হোসেন হাওলাদার বলেন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সব হাইওয়েতে চাঁদাবাজি বন্ধে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফলে শুধু চাল বা খাদ্য পণ্য কেন, কোনো যানবাহনে হাইওয়ে পুলিশ চাঁদা তুলে না। তবে মহাসড়কে জেলা পুলিশ বা ট্রাফিকের লোকরাও দায়িত্ব পালন করেন। সেক্ষেত্রে কারা এটা করছে, তা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে।

উত্তরবঙ্গের একাধিক চালকল মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, উত্তরবঙ্গের চালপ্রধান তিন জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও দিনাজপুর থেকে ১০০ ট্রাক করে ৩০০ ট্রাকসহ উত্তরাঞ্চলের সব জেলা থেকে প্রতিদিন ৫০০ ট্রাক চাল চালান হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। দেশের বিভিন্ন মোকামের পাইকার ও আড়তদারদের অগ্রিম অর্ডার পেয়ে তারা নিজস্ব ট্রাকে চাল পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। মিলগেটের দামেই চালকল মালিকরা বিভিন্ন মোকামে চাল পৌঁছে দেন। কিন্তু চাল পৌঁছাতে সড়কে চাঁদা দিতে গিয়ে তারা বিপাকে পড়ছেন। ফলে চালের দামও তারা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক চালকল মালিক বলেন, ট্রাক চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলগেট ছাড়ার পর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কিংবা খাতুনগঞ্জ পৌঁছতে মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা দিতে হচ্ছে পুলিশকে। রাজশাহী বাইপাস, বেলেপুকুর, নাটোর বাইপাস, বনপাড়া, হাটিকুমরুল, সিরাজগঞ্জের কড্ডার মোড়, দিনাজপুর-রংপুর থেকে বগুড়া পর্যন্ত ৫টি পয়েন্টে, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা, মির্জাপুর বাইপাস, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, চন্দ্রা, কোনাবাড়ী, জয়দেবপুর চৌরাস্তা, টঙ্গী, বাইপাইল, নবীনগর, হেমায়েতপুর পর্যন্ত ট্রাক ভেদে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিচ্ছে পুলিশ। এর মধ্যে হাইওয়ে পুলিশ যেমন আছে, তেমনি জেলা পুলিশের টহল দল ছাড়াও ট্রাফিক সার্জেন্টরাও চাঁদা নিচ্ছেন ট্রাক আটকে। তবে ট্রাফিকদের চাঁদার জুলুম বেশি বলে এক ট্রাকচালক অভিযোগ করেন।

মহিবুল ইসলাম নামে রাজশাহীর এক ট্রাকচালক জানান, ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চাল নিয়ে প্রথমে মিরপুর ৬নং বাজারে অর্ধেক চাল আনলোড করে মানিকগঞ্জ যাচ্ছিলেন। হেমায়েতপুরে তার ট্রাক আটকান দুই ট্রাফিক সার্জেন্ট। তিন ঘণ্টা আটকে রেখে ২ হাজার টাকা নিয়ে পরে ট্রাক ছাড়েন। এ ট্রাকচালক আরও বলেন, ঢাকা মহানগরীর মোহাম্মদপুর কৃষিবাজার, বাদামতলী, কাপ্তানবাজারসহ বিভিন্ন মোকামে ট্রাক নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাফিক সার্জেন্ট সামনে পড়লেই ট্রাক আটক করে অন্তত ২ হাজার টাকা না নিয়ে ছাড়েন না। ট্রাকের কাগজপত্রসহ সবকিছু ঠিক থাকলেও সার্জেন্টরা কোনো না কোনো ছুতা বের করে শুধু চাঁদার জন্য ট্রাক আটকাচ্ছেন। পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তি না থাকলেই কাগজপত্র আটকে রেখে হয়রানি করছেন সমানে।

নওগাঁর এক চালকল মালিক ও একাধিক ট্রাকচালক বলেন, উত্তরবঙ্গ থেকে চট্টগ্রাম, ফেনী, চাঁদপুর, নোয়াখালীগামী চালের ট্রাক থেকে মেঘনা-গোমতী সেতুর দাউদকান্দি ও বড়দারোগার হাট ওজন পরিমাপক কেন্দ্রে ১ হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্টে দালালদের ১ হাজার দিলেই ট্রাককে আর জরিমানা করা হয় না। টাকা না দিলেই চালের ট্রাককে ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। ট্রাকচালকরা আরও জানান, ৬ চাকার ট্রাকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য সীমা ১৫ টনের বেশি চাল লোড করা সম্ভব নয়। কিন্তু ১২-১৩ টন থাকলেও চাঁদা দিতে হচ্ছে। চালকল মালিক ও ট্রাকচালকরা প্রমাণ হিসেবে চালকলের দেয়া মিলগেটের ওজনের চালান ও চাঁদাবাজিসহ জরিমানার একাধিক কাগজ এই প্রতিবেদকের কাছে দেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তরবঙ্গ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মান্নান আকন্দ বলেন, কাগজ দেখার নাম করে ট্রাক আটকে মহাসড়কে পুলিশের চাঁদাবাজি ও ওজন স্টেশনে বেপরোয়া চাঁদাবাজি বন্ধসহ সাত দফা দাবিতে ৩০ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্তরাঞ্চল থেকে সব ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে ২৬ জানুয়ারিও পণ্য পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রত্যাহার করা হয়। এ পরিবহন নেতা আরও বলেন, সরকার আমাদের কিছু দাবি বাস্তবায়ন করলেও সড়কে চাঁদাবাজিসহ চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি ও দারোগার হাটের স্কেল স্টেশনে এখনও ভয়াবহ চাঁদাবাজি হচ্ছে- এমন অভিযোগ আমরা ট্রাক মালিক ও চালকদের কাছ থেকে পাচ্ছি।