ঘুষ সিন্ডিকেট-নাকাল শিক্ষকরা-কবে ভাল হবে শিক্ষা ভবন?
নীপা খন্দকার.ঢাকা: ঘুষ সিন্ডিকেট থেকে কবে ভাল হবে শিক্ষা ভবন? নাকি এই ভবনটি ভাল হওয়ার শিক্ষা পায়নি? নাকি এই ভবনের বাসিন্দারা ভাল হওয়ার শিক্ষা নেন না? এ ধরনের নানা অপপ্রচার শিক্ষা ভবনের বিরুদ্ধে হলেও কোন শিক্ষকই ঘুষ ছাড়া কাজ বাগিয়ে নিতে পারেননি এই ভবন থেকে।এই ভবনে বদলায়নি শুধু ঘুষ এবং অবৈধ লেনদেন। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে্।পদে পদে ‘হয়রানির’ নানা শিকার হলছে অব্যাহত গতিতে।
মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘আমার কাছে সব ফাইল আসে না। যেগুলো আসে সেগুলো দেখে বুঝতে পারি কোনটাতে ঝামেলা আছে, কোনটাতে নেই’। তিনি বলেন, আমি আসার পর সবাই ভালো হয়ে গেছে তা বলব না। এখানে এখনো একটি আঞ্চলিক সিন্ডিকেট কাজ করছে। তারপরও বলব, অন্তত আশি ভাগ দুর্নীতি বন্ধ করতে পেরেছি। দুর্নীতি রোধে নিয়মিত অডিট করা হচ্ছে।
কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় শিক্ষা ভবনে এসে একজন গ্রামের শিক্ষক যেভাবে অপমান-অপদস্ত হন তা অমানবিক। এতে ওই শিক্ষকের মনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং শিক্ষকতা পেশায়ও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শিক্ষকরা যাতে নিজের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু পেতে পারেন সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবার নজর দেওয়া উচিত।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা শিক্ষা ভবনের ঘুষের রীতি ‘ওপেন সিক্রেট’। শিক্ষামন্ত্রী নিজেও এ বিষয়ে কম ওয়াকিবহাল নন। আর সে কারণেই শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করতে মন্ত্রী নিজেই বিভিন্ন সময়ে আলোচিত পদক্ষেপ নিয়েছেন।
দুই বছর হলো মহাপরিচালকের আসনে বসানো হয়েছে অধ্যাপক ফাহিমা খাতুনকে। তার নির্দেশে মূল ফটকে রাখা হয়েছে অভিযোগ বা·। আর ভবনজুড়ে বসানো হয়েছে ৩২টি ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরা। সাম্প্রতিককালে শিক্ষা ভবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ অনলাইন সিস্টেমের আওতায় এনে একটি কোম্পানিকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন মহাপরিচালক অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিয়েছেন। বাতিল করেছেন ২৭৩টি এমপিওভুক্তি। এখনো চার-পাঁচজন কর্মকর্তা এবং বেশ কিছু কর্মচারীর বিরুদ্ধে চলছে দুদকের মামলা। দুই অংশে বিভক্ত হয়ে আগের মতো সক্রিয় নেই শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠনের নেতারাও। এত কিছুর পরও থামেনি দুর্নীতি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুর্নীতিবাজরা মাউশি প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে আগের মতো প্রশ্রয় না পাওয়ায় ঘুষ বাণিজ্য করছে ভবনের বাইরে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কখনো উত্তর গেট সংলগ্ন আশপাশের চায়ের দোকান আবার কখনো বা পার্টিকে নিয়ে যান নিজেদের বাড়ি কিংবা নিরাপদ দূরত্বের বড় কোনো রেস্তোরাঁয়। সেখানেই ‘খরচপাতি’ নামক ব্যয় খাত দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অঙ্কের ঘুষ।
এরপর পিওন থেকে শুরু করে ঊধ্র্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত ভাগবাটোয়ারা হয় এই ঘুষের টাকা। থেমে নেই ঘুষবাণিজ্য। শিক্ষামন্ত্রী বা মাউশির বর্তমান মহাপরিচালকের কঠোর মনোভাব দুর্নীতিবাজরা যেন থোড়াই কেয়ার করে!
আনোয়ার হোসেন নামে ঝিনাইদহ থেকে আসা এক ভুক্তভোগী শিক্ষক বললেন, ‘এখানে খরচপাতি না দিলে ফাইল গায়েব হয়ে যায়। এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলের দূরত্ব হয়ে যায় হাজার হাজার মাইল। মাসের পর মাস মাউশির দুয়ারে ধরনা দিলেও ফাইল পৌঁছায় না কাক্ষিত টেবিলে। আর সে কারণেই শিক্ষক হয়েও নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হলাম।
জানা গেছে, দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে মাউশি প্রশাসনের প¶ থেকে প্রায়ই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটির এসব রিপোর্টে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ উঠে আসার মতো ঘটনা ঘটে। তারপরও বদলায় না মাউশির চিত্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমপিওভুক্তি শাখার এক কর্মকর্তা জানান, এই শাখায় দুর্নীতি করার মতো অনেক সুযোগ রয়েছে। প্রতিবছর এখানে সাত-আট কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়। এখানে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এমপিওভুক্তির জন্য পাঠানো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক তথ্যে অনেক গরমিল করার সুযোগ থাকে। এমপিও প্রত্যাশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে অফিস সহকারীরা এসব তথ্যে গরমিল করে থাকেন। কর্মকর্তারা অনেক সময় এসব সূক্ষতম জালিয়াতি ধরতে পারেন না। আর এ ক্ষেত্রে দুর্নাম বেশি মাদ্রাসা শাখায়।
একটি সূত্র জানায়, গ্রামের নিরীহ শিক্ষকরাই এখানে বেশি হয়রানির শিকার হন। গেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসারদের প্রাথমিক লাঞ্ছনা অতিক্রম করে শিক্ষকদের ঢুকতে হয় এই ভবনে। দর্শনার্থী কক্ষে পৌঁছানোর পর পরিচিত কোনো কর্মকর্তার নাম বলতে না পারলে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না তাদের। কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন, কার কাছে যাবেন এমন হাজারো প্রশ্নের জবাব দিয়ে আনসার সদস্যদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তবেই না ভিতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে। আনসার সদস্যরাও নাকি শিক্ষকের চাল-চলন পোশাক দেখে বুঝতে পারেন কে গ্রাম থেকে এসেছেন আর কে শহরের। আর তাদের সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করেন তারা।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষা ভবনে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য এসেও অন্তত ৮-১০টি পয়েন্টে ঘুষ দিতে হয়। তবে প্রশাসন কড়া হওয়ার কারণে ইদানীং দুই-তিনটি পয়েন্টে দিলেই চলে। পরে সে অর্থ ভাগ হয়ে যায় বাকিদের মধ্যে। অভিযোগ রয়েছে, এই ভবনে সক্রিয় রয়েছে আঞ্চলিক সিন্ডিকেটও। শক্তিশালী এমন একটি আঞ্চলিক সিন্ডিকেটভুক্ত একজন সহকারী পরিচালক এমপিওর ফাইল সই করে মন্ত্রণালয়ের পাঠাতে ফাইল প্রতি ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা নেন। ফাইল জমা দেওয়ার পরই উচ্চমান সহকারীদের পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে প্রাথমিক কন্ট্রাক্ট করতে হয়। আর তা না হলে হারিয়ে যায় ফাইল। ফাইল যাতে না হারায় এর জন্য পিওনকে দিতে হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। শুধু ফাইল হারানোর অভিযোগেই শিক্ষা ভবনে কিছু দিন পর পর তদন্ত কমিটি গঠন করতে হয়।