ঘুষের সম্রাট ছিল এক্সেন ছাবিউল
ঠিকাদারদের কাজ দিতে পার্সেন্টেজ গুনে টাকা নিয়ে কাজ ছাড় করতো সে। নাটোরের সিংড়ায় গাড়ি তল্লাশির সময় উদ্ধারকৃত প্রায় ৩৭ লাখ অবৈধ টাকার মালিক গাইবান্ধার এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম। টাকার উৎসের কোনো কাগজ দেখাতে পারেনি সে।
লাবণ্য চৌধুরী : কেঁচো খুড়তে শাপ বেরিয়ে যাচ্ছে ঘুষের সম্রাট ছাবিউল ইসলামের। ঠিকাদারদের কাজ দিতে পার্সেন্টেজ গুনে টাকা নিয়ে কাজ ছাড় করতো সে। নাটোরের সিংড়ায় গাড়ি তল্লাশির সময় উদ্ধারকৃত প্রায় ৩৭ লাখ অবৈধ টাকার মালিক গাইবান্ধার এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী ছাবিউল ইসলাম। টাকার উৎসের কোনো কাগজ দেখাতে পারেনি সে। বৃহস্পতিবার রাতে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের সদরের চলনবিল গেট এলাকায় পুলিশ সেনাবাহিনীর তল্লাশীর সময় টাকাসহ ধরা পড়েন এক্সেন ছাবিউল ইসলাম। জব্দকৃত টাকা এখন আদালতের হেফাজতে। আদালত অবৈধ ওই টাকার উৎস খুঁজতে দুদককে দায়িত্ব দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর সাঘাটা উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধা জেলায় এসেছিলেন মো. ছাবিউল ইসলাম। বর্তমানে তিনি গাইবান্ধা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী। এই দীর্ঘ ২১ বছর তিনি গাইবান্ধা জেলাতেই কর্মরত আছেন। মাঝখানে তাঁকে বরিশালে বদলি করা হলেও ২৩ দিনের মাথায় আবারও গাইবান্ধায় চলে আসেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে গাইবান্ধা থেকে রাজশাহী যাওয়ার পথে নাটোরের সিংড়া উপজেলায় এই প্রকৌশলীর গাড়ি তল্লাশি করে প্রায় ৩৭ লাখ টাকা জব্দ করেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। গাইবান্ধা এলজিইডির ঠিকাদারেরা বলছেন, ছাবিউল ইসলাম দীর্ঘ সময় একই জেলায় থাকার কারণে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠেন। ঠিকাদারেরা তাঁর কাছে একরকম জিম্মি হয়ে পড়েন। ঘুষ (পারসোনাল কমিশন-পিসি) ছাড়া ফাইল সই করেন না বলে অভিযোগ করেছেন ঠিকাদারেরা।
গাইবান্ধা এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ছাবিউল ইসলামের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। বর্তমানে তিনি রাজশাহী নগরে বাড়ি করেছেন। সেখানেই বসবাস করেন। তিনি ২০০৫ সালের ২১ ডিসেম্বর উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে গাইবান্ধার সাঘাটায় যোগদান করেন। এখানে কর্মরত থাকেন ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করেন টানা ১৪ বছর ১ মাস ২২ দিন। এরপর জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে ছাবিউল ইসলাম এলজিইডি গাইবান্ধা জেলা কার্যালয়ে যোগ দেন। এই পদে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের বছরের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ বছর ৬ মাস ২৮ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি সাঘাটা উপজেলায় (উপজেলা প্রকৌশলী) অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন।
এলজিইডি কার্যালয় সূত্র জানায়, ছাবিউল ইসলাম নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বরিশাল জেলায় যোগ দেন। সেখানে মাত্র ২৩ দিন দায়িত্ব পালন করেন। তদবির করে একই সালের ৬ অক্টোবর গাইবান্ধায় বদলি নেন। পরদিন ৭ অক্টোবর তিনি গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। একই বছরের ৮ নভেম্বর তিনি পূর্ববর্তী নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন। সাঘাটায় যোগদানের পর থেকে চলতি বছরের ১৩ মার্চ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ২০ বছর ৯ মাস ৮ দিন গাইবান্ধা জেলায় কর্মরত।
ঠিকাদার ও এলজিইডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাবিউল ইসলাম জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের সংসদ সদস্য প্রয়াত ফজলে রাব্বী মিয়ার ”পোষ্যপুত্র” বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দাপটেই ছাবিউল ইসলাম দীর্ঘদিন গাইবান্ধায় থাকার সুযোগ পান।পরে ২০২২ সালের ২২ জুলাই ফজলে রাব্বী মারা গেলেও তিনি আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন।
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী, একজন সরকারি কর্মকর্তা একই কর্মস্থলে টানা তিন বছরের বেশি থাকার কথা নয়। কিন্তু এই বিধি উপেক্ষা করে টানা প্রায় ২১ বছর ধরে এক জেলাতেই ঘুরেফিরে দায়িত্ব পালন করেন। ওপর মহলে তদবির করে সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে ঘুরেফিরে এত দিন অনিয়ম-দুর্নীতি পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। গাইবান্ধার এক ঠিকাদার বলেন, একই জেলায় দীর্ঘদিন থাকার কারণে ওই প্রকৌশলী নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষত ঠিকাদারেরা তাঁর কাছে জিম্মি ছিলেন। ঘুষ ছাড়া ফাইল সই করতেন না।
এলজিইডির তালিকাভুক্ত ঠিকাদার মিলন মিয়া অভিযোগ করেন, ওই নির্বাহী প্রকৌশলী প্রথম বিল সই করার সময় শতকরা ৫ ভাগ এবং চূড়ান্ত বিল সই করতে শতকরা ১০ ভাগ টাকা ঘুষ নিতেন। টাকাসহ ধরা পড়ার ঘটনাটি সঠিকভাবে তদন্ত করলে রহস্য উদ্ঘাটন হবে।
একাধিক ঠিকাদার ও এলজিইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ঘুষ নিয়ে বিল ছাড় করা ছাড়াও তিনি সড়ক নির্মাণকাজে নিজেই পাথর, বিটুমিন, ইটের খোয়া ও রড ঠিকাদারদের কাছে সরবরাহ দিতেন।
এদিকে ছাবিউল ইসলামের গাড়ি থেকে জব্দ করা প্রায় ৩৭ লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রোববার বিকেলে নাটোরের সিংড়া আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহান এ আদেশ দেন। এর আগে এ ঘটনায় করা সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্তকারী কর্মকর্তা সিংড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু আহমেদ জব্দ করা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ চেয়ে দুপুরে আদালতে আবেদন করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত দুইটার দিকে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের সদরের চলনবিল গেট এলাকায় তল্লাশির সময় প্রাইভেট কার থেকে এসব টাকা জব্দ করা হয়। শুক্রবার বিকেলে নির্বাহী প্রকৌশলীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রাইভেট কারটি সিংড়া থানা হেফাজতে আছে।
জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই রাজু আহমেদ জানান, টাকাগুলো এলজিইডির কর্মকর্তা জমি বিক্রির টাকা বলে দাবি করলেও এর সমর্থনে কোনো কাগজপত্র জমা দিতে পারেননি। তাই টাকার বৈধতা নিরূপণের জন্য তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনে আবেদন পাঠিয়েছেন। তাঁরা তদন্ত করে টাকার উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।