• শুক্রবার , ২২ নভেম্বর ২০২৪

‘গ্যাষ্ট্রিক’ এর টাকায় পদ্মা ব্রীজ!


প্রকাশিত: ৯:৫৬ পিএম, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫৮৫ বার

Gartric tab-www.jatirkhantha.com.bd
এস রহমান  :   ‘গ্যাষ্ট্রিক’ বাংলাদেশে  মহামারী আকার ধারন করেছে। প্রতিটি ঘরে ঘরে এ রোগে  আক্রান্ত মানুষ। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে রাসায়নিকসহ নানা খাবার সামগ্রীর নানা ঝামেলায় মানুষ এখন আক্রান্ত হচ্ছে এই  ‘গ্যাষ্ট্রিক’ রোগে। গবেষণায় মিলেছে এই রোগে আক্রান্তরা গত এক বছরে শুধু একটি ওষুধ কোম্পনিকেই দিয়েছে দেশের বহুল প্রতিক্ষিত পদ্মা ব্রীজের প্রায় সমান টাকা। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন, ‘গ্যাষ্ট্রিক’ কেড়ে নিচ্ছে পদ্মা ব্রীজের টাকা!

222গবেষণায় মিলেছে, গত বছর সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধের তালিকায় শীর্ষে ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধ ‘সেকলো’। এটি গ্যাষ্ট্রিক এর ওষুধ। ওষুধটি বিক্রি হয়েছে ৩৭৬ কোটি ৬৫ লাখ ৬০ হাজার টাকার। বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ২ শতাংশ। স্কয়ারের ৮০৪ ধরনের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, লিকুইড ও ইনজেক্টেবল ওষুধের মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন ও বিক্রি সেকলোরই। দেশের বাজারে গত বছর কোম্পানির মোট বিক্রি ছিল ৩ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অগ্রসরমান মানুষের জীবন যাত্রায় নানা পরিবর্তনের ফলে এই রোগ এখন মহামারী’র মতো। খাওয়া থেকে ঘুমানো, সব ক্ষেত্রেই অনিয়মের ছাপ। অনিয়মতান্ত্রিক এ জীবনযাপনে দেখা দিচ্ছে অ্যাসিডিটিসহ নানা সমস্যা। এতে বাড়ছে গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধের ওপর নির্ভরতা।  গবেষণা বলছে, দেশে সর্বাধিক বিক্রীত ১০টি ওষুধের মধ্যে ছয়টিই গ্যাস্ট্রো-ইসোফ্যাজিল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) ক্যাটাগরির।

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএমএস হেলথ  বলেছে, দেশে ওষুধ শিল্পের বর্তমান বাজার প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার। এ বাজারের অর্ধেকই গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের। সর্বাধিক বিক্রীত ১০ ওষুধের মধ্যে এ দুই ক্যাটাগরির ওষুধের সংখ্যা সাতটি।২০১৭ সালে দেশের বাজারে সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধের ১০টি ব্র্যান্ড হলো— সেকলো, সার্জেল, ম্যাক্সপ্রো, প্যানটোনিক্স, সেফ-৩, মিক্সটার্ড ৩০, লোসেকটিল, নাপা এক্সট্রা, নাপা ও ফিনিক্স। এর মধ্যে শুধু গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধই রয়েছে ছয়টি। আর ওষুধ শিল্পের গড় প্রবৃদ্ধি ১৯ শতাংশ হলেও গ্যাস্ট্রোনমিক্যালের প্রবৃদ্ধি ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সর্বাধিক বিক্রীত ১০ ওষুধের তালিকায় অ্যান্টি-পাইরেটিক বা প্যারাসিটামল গ্রুপের জ্বরের ওষুধ দুটি, একটি অ্যান্টিবায়োটিক ও অন্যটি ইনসুলিন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জাতিরকন্ঠকে জানিয়েছেন,  অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, সময়মতো খাবার না খাওয়া, ভেজাল খাবার, ফাস্টফুড, অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া, ধূমপান ও মদ্যপানের কারণে মানুষের মধ্যে অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিক এর  সমস্যা হচ্ছে। অন্যদিকে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই এ ওষুধ সেবনের সুযোগ থাকায় মানুষের মধ্যে তা গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ কেনার প্রবণতাও বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. শহিদুল্লাহ জাতিরকন্ঠকে জানিয়েছেন, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে। সে কারণে বাজারে অ্যাসিডিটির ওষুধের চাহিদা বেশি। এছাড়া পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম থাকায় মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ কিনতে পারে বলে এ ওষুধ কেনার হার বেশি।

জানা গেছে, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্জেলের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৭ সালে বাজারে ওষুধটির বিক্রি ছিল ২৯৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকার। তৃতীয় স্থানে থাকা রেনাটা ফার্মার ম্যাক্সপ্রোর বিক্রি ২২৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার। ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিখ্যাত হলেও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ প্যানটোনিক্সের বাজারের বড় অংশ দখলে নিয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। ২০১৭ সালে ২০ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শীর্ষ তালিকার চতুর্থ স্থানে কোম্পানিটি থাকা ২১৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার প্যানটোনিক্স বিক্রি করেছে।

ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির বলেন, আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। মানুষ সাধারণ খাবার বাদ দিয়ে স্পাইসি খাবারে ঝুঁকছে। এসবের কারণে অ্যাসিডিটি সমস্যা তৈরি হচ্ছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়াও গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধ বিক্রি বাড়ার কারণ। তবে ভবিষ্যতে এসব ওষুধের পরিবর্তে ডায়াবেটিস ও হার্ট ডিজিজের ওষুধ বিক্রি বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।

শীর্ষ তালিকার সপ্তম স্থানে রয়েছে এসকেএফ ফার্মার লোসেকটিল। ২০১৭ সালে গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ওষুধটি বিক্রি হয়েছে ২২২ কোটি ১৬ লাখ টাকার। আর দশম স্থানে থাকা অপসোনিন ফার্মার ফিনিক্সের বিক্রি হয়েছে ১০০ কোটি ১৪ লাখ টাকা। গত বছর ওষুধটিতে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে অপসোনিন।অন্যদিকে ওষুধের মূল উপাদান মলিকিউলসের বাজারেও শীর্ষ অবস্থান গ্যাস্ট্রোনমিক্যালের। এক্ষেত্রে ইসমিপ্রাজলের মার্কেট শেয়ার ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে থাকা ওমিপ্রাজলের মার্কেট শেয়ার ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রিজভী জাতিরকন্ঠকে বলেন, গ্যাস্ট্রিক বা পেপটিক আলসার ডিজিজের জন্য গ্যাসের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এ রোগের প্রকোপ বেশি। এছাড়া ভেজাল খাবার, খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ধূমপান, মদ্যপানের কারণে এ রোগের প্রকোপ আরো বাড়ছে। ফলে দিন দিন এ ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। অধিকাংশ মানুষকে নিয়মিত এ ওষুধ খেতে হয়। ফলে মানুষের ওষুধের ব্যয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ যাচ্ছে গ্যাসের ওষুধের পেছনে।

গবেষণা তথ্যানুসারে, ২০১৭ সাল শেষে দেশে ২৬৯টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন থাকলেও উৎপাদনে রয়েছে ২১৬টি কোম্পানি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ওষুধ জেনেরিক। দেশে উৎপাদিত ওষুধের ২৬ হাজার ৬৬১ ব্র্যান্ডের মধ্যে ১ হাজার ৪৪৪টি জেনেরিক। আর প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে সবার উপরে রয়েছে স্কয়ার। দ্বিতীয় স্থানে ইনসেপ্টা, তৃতীয় স্থানে বেক্সিমকো। এরপর রয়েছে যথাক্রমে অপসোনিন, রেনাটা, হেলথকেয়ার, এসিআই, অ্যারিস্টোফার্মা, এসকেএফ ও একমি ল্যাবরেটরিজ।