• শুক্রবার , ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

গ্যাং শ্রীলংকা সিন্ডিকেট পাকরাও!


প্রকাশিত: ৯:৪৬ পিএম, ২৯ জানুয়ারী ১৯ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১১৭ বার

গ্যাং শ্রীলংকা সিন্ডিকেট-

স্টাফ রিপোর্টার : আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের নয়া শ্রীলংকা সিন্ডিকেট এর একটি বড় গ্যাং পাকরাও করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। শ্রীলংকায় জব্দকৃত মাদকদ্রব্য চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের পাঁচ সক্রিয় সদস্যকে গতকাল সোমবার বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

আটককৃতরা হলেন-ফাতেমা ইমাম তানিয়া (২৬), আফসানা মিমি (২৩) ও সালমা সুলতানা (২৬)। অন্য দুজন শেখ মোহাম্মদ বাঁধন ওরফে পারভেজ (২৮) ও রুহুল আমিন ওরফে সায়মন (২৯)। বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ তাদের গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মিডিয়া সেন্টারে এ ব্যাপারে একটি প্রেস ব্রিফিং করে র‌্যাব। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সেখানে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ সদস্যের পরিচিতি তুলে ধরেন।

গ্রেপ্তারকৃত পাঁচ সদস্যের মধ্যে অন্যতম ফাতেমা ইমাম তানিয়া (২৬)। শরীয়তপুরের গোছাইর হাট এলাকার বাসিন্দা তিনি। মুফতি মাহমুদ খান জানান, নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর ২০০৮ সাল হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। ২০১৬ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং করার সময় সহপাঠী ফারহানা ও গ্রেপ্তার রুহুল আমিনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরে এদের মাধ্যমেই তিনি পরিচিত হন চোরাচালান চক্রের অন্যতম সদস্য রেহানার সঙ্গে। ২০১৬ সালে তার প্ররোচনা ও অর্থের প্রলোভনে তাদের চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন তানিয়া।

চোরাচালান চক্রে জড়িত হওয়ার পর দুইবার ভারতে, তিনবার চীনে ও আট থেকে ১০ বার মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকা ভ্রমণ করেন তিনি। মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকা ভ্রমণের সময় নিজস্ব লাগেজের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য বহন করতেন তিনি। শ্রীলংকায় যাতায়াতের জন্য দেশটির বিভিন্ন স্থানে ৪টি বাসা ভাড়া করে তাদের দল।

তানিয়া জানিয়েছেন, বাসাগুলো ভাড়া করতে তারা মিমি ও অন্যান্য সদস্যদের ডকুমেন্ট ব্যবহার করতেন। ওই চারটি বাসা ছাড়াও শ্রীলংকার বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকটি বাসা রয়েছে। শ্রীলংকায় অবস্থানকালীন সময় তিনিসহ চক্রটি দেশ বিদেশে বিভিন্ন কৌশলে মাদক সংগ্রহ, সরবরাহ ও বিতরণ করতেন।এই দলের অন্যতম সদস্য আফসানা মিমি (২৩)। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এলাকার বাসিন্দা মিমি ২০১৫ সালে মিডিয়া জগতে কাজ করতে ঢাকা আসেন। তার বাবার নাম মো. আশরাফ উল্লাহ।

মুফতি মাহমুদ জানান, ২০১৫ সালে মিডিয়া জগতে কাজ করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন মিমি। নাচ, গান এবং অভিনয়ে পারদর্শী হওয়ায় সহজেই বিভিন্ন ক্লাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এই সূত্রেই তার পরিচয় হয় মাদক চোরাচালান চক্রের সদস্য ও একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল কর্মরত রুহুল আমীন সায়মনের সঙ্গে। এর পর রুহুলের মাধ্যমেই তার পরিচয় হয় চোরাচালান চক্রের অন্য সদস্য রেহানা ও আরিফের সঙ্গে।

পরবর্তীতে আরিফের সঙ্গে মিমির ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার মাধ্যমেই ২০১৭ সালে মিমি আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর একই সালে তিনি অরিফের সঙ্গে মালয়েশিয়া যান। সেখান থেকে রেহানা ও মিমি মাদকের একটি চালান নিয়ে শ্রীলংকা যান।কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান আরও জানান, ২০১৮ সালের শুরুর দিকে মিমি দ্বিতীয়বারের মতো শ্রীলংকায় গেলে আরিফ তার সঙ্গে পরিচয় করান চোরাচালান চক্রের অন্যতম সদস্য সূর্যমনির সঙ্গে। প্রায় ২৫ দিন শ্রীলংকায় অবস্থান করেন মিমি। সেখানে এ সময়গুলোতে সূর্যমনির নির্দেশে বিভিন্ন এলাকায় মাদক সরবরাহ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা ফিরে আসেন তিনি।

২০১৮ সালের শেষের দিকে পুনরায় শ্রীলংকা গিয়ে একটি বাসায় কিছুদিন অবস্থান করেন মিমি। সেখানে বিভিন্ন দেশে চালান করার মাদকগুলো তিনি নিজের কাছে মজুদ করে রাখতেন। পরে আবারও বাংলোদেশে ফেরত আসেন তিনি।তানিয়া ও মিমির সঙ্গে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার সালমা সুলতানা (২৬) ২০১০ সালে এইচএসসি পাশের পর পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কাজ শুরু করেন। মানিকগঞ্জ জেলার সরুপাই গ্রামের বাসিন্দা সালমা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট চাকরির সুবাদে পরিচিত হন গ্রেপ্তার তানিয়ার সঙ্গে। পরে তার মাধ্যমেই পরিচিত হন চোরাচালান চক্রের অন্যতম সদস্য রেহানার সঙ্গে। ২০১৭ সালে তিনি মাদক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। সেই সুবাদে মাদকসহ তিনি চীন, শ্রীলংকা ও ভারত ভ্রমণ করেন।

এই চক্রের অপর সদস্য বগুড়া জেলার জহুরনগর এলাকার বাসিন্দা শেখ মোহাম্মদ বাধন ওরফে পারভেজ (২৮)। কাজ করতেন একটি বায়িং হাইজে। এলাকা ও কাজের সূত্রে বাংলাদেশে মাদক চোরাচালানের মূল হোতা ও নিয়ন্ত্রক আরিফ উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে আরিফের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আল-আমিন ফ্যাশন বায়িং হাউজে যোগদান করেন তিনি। আরিফের নির্দেশনায় তিনি ২০১৮ সালে শ্রীলংকা ভ্রমণ করেন তিনি। সেখানে মাদকের চালানসহ প্রায় ১ মাসের বেশি সময় অবস্থান করেন। এ সময় তিনি দেশটির বিভিন্ন স্থানে মাদক দ্রব্য প্যাকেজিং, সংগ্রহ ও সরবারহের কাজ করতেন বলে জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।

চক্রের অপর হোতা রুহুল আমিন ওরফে সায়মন (২৯)। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কর্মরত সায়মন শরীয়তপুরের সখীপুর এলাকার বাসিন্দা। মুফতি মাহমুদ জানান, আত্মীয়তার সূত্রে রেহানা আক্তারের মাধ্যমে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। রেহানার নির্দেশনায় সে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের প্রলোভন দেখিয়ে চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যুক্ত করতেন। এছাড়া এই মাফিয়া মাদক সিন্ডিকেটের জন্য পাসপোর্ট, ভিসা এবং টিকেটিংয়ের কাজ করতেন তিনি। গ্রেপ্তার তানিয়া, মিমি ও সালমা তার হাত ধরেই এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। প্রতিটি পাসপোর্ট, ভিসা, টিকেটিংয়ের জন্য ৫-১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত অর্থ তাকে দেওয়া হতো। র‌্যাবের কাছে প্রতিটি ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনি।

এছাড়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা যে জবানবন্দি দিয়েছেন তাতে মো. আরিফ উদ্দিন নামে যে ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, তিনি মূলত এই চক্রটির পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন, আরিফ তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আল-আমিন ফ্যাশন বায়িং হাউসে বসেই বাংলাদেশে চক্রটি পরিচালনা করতেন। ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দলকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। দেশের অভ্যন্তরেও তিনি মাদক ব্যবসা পরিচলনা করেন।

মুফতি আরও জানান, আরিফ নিজে বিভিন্ন জনকে তার চক্রে রিক্রুট করতেন। এ ছাড়া তার মাধ্যমে গ্রেপ্তার সায়মন ও চক্রের অন্য সদস্য রেহানাও রিক্রুটিংয়ের কাজ করে থাকতেন। রিক্রুটিং এর ক্ষেত্রে মূলত স্বল্প শিক্ষিত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত স্মার্ট মেয়েদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে তাদেরকে ব্যবসায়িক কাজে নিয়োজিত করা হতো। এরপর বিশ্বস্ততা বিচার করে দেশের অভ্যন্তরে তাদের মাদক ব্যবসা, সংগ্রহ, সরবরাহ ও বিতরণের জন্য ব্যবহার করা হতো।

পরবর্তীতে তাদের বিদেশে পাঠিয়ে বিভিন্ন কালচারের সঙ্গে মানাতে অভ্যস্থ এবং পাসপোর্টের যোগ্যতা বাড়ানোর কাজ করতেন। তাদেরকে বিদেশে মাদক সরবরাহ ও বিতরণের কাজেও ব্যবহার করা হয়। এই সিন্ডিকেটটি আফগানিস্তান, পাকিস্তান, চীন, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকায় নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে থাক। বিভিন্ন পথে তারা মাদক পরিবহন করে থাকে বলেও জানান মুফতি মাহমুদ খান।