‘গোসল করে তওবা কর নামাজ পড় তোদের আয়ু শেষ’
গাইবান্ধা প্রতিনিধি : ‘গোসল করে তওবা কর, নামাজ পড়, তোদের আয়ু শেষ’-গুম হওয়ার পর এভাবেই বলা হয়েছিল অপহৃতদের। মুক্ত হওয়ার পর গুম হওয়া প্রিন্স ও শাপলা এভাবেই ব্যক্ত করলেন তাদের অনূভূতি। ‘ তারা বললেন, আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাই আমাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তবে তারা কোন বাহিনীর সদস্য তা বুঝতে পারিনি। ১১ দিন আমরা কোথায় ছিলাম তাও বুঝতে পারিনি। তবে একটি জায়গায় পাশাপাশি কামরায় চোখ বাঁধা অবস্থায় রাখা হয়েছিল আমাদের। আমাদের কোন জিনিসপত্রও খোয়া যায়নি।
মাঝে-মধ্যে অসুস্থ হলে ডাক্তার ডেকে এনে চিকিত্সাও করানো হয়েছে।’—১১ দিন নিখোঁজ থাকার পর বাড়ি ফিরে এসব কথা বললেন গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের নলডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মাইদুল ইসলাম প্রিন্স। ফিরে আসা অপর নেতা একই ইউনিয়নের যুবদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক শফিউল ইসলাম শাপলাও একই কথা বলেছেন।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ডের পর পার্শ্ববর্তী সাদুল্লাপুর উপজেলার চার নেতা নিখোঁজ হন। শনিবার ভোরে বাড়ি ফেরেন প্রিন্স ও শাপলা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ভোর রাতে বাড়ি ফেরেন অপর দুই নিখোঁজ উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি, দামোদরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মনোয়ারুল হাসান জীম মণ্ডল এবং দামোদরপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সাদেক।
এই চার নেতা নিখোঁজ হওয়ার পর সাদুল্লাপুর থানায় অভিযোগ দায়ের ও সাধারণ ডায়েরি করেন তাদের পরিবারের লোকজন। এছাড়া তাদের সন্ধান দাবিতে ৯ দিন ধরে সাদুল্লাপুর শহর ও নলডাঙ্গায় মিছিল-মিটিং, হরতাল-অবরোধ, মানববন্ধন, থানা ঘেরাও কর্মসূচি এবং সাংবাদিক সম্মেলন করেন এলাকাবাসী ও স্বজনরা। তাদের পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, সাদা পোশাকে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা এই চারজনকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু জেলা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও তাদের সন্ধান দিতে পারেননি।
প্রিন্সের বড় ভাই নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও নলডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম নয়ন বলেন, ‘শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে প্রিন্স আমাকে মোবাইলে ফোন করে জানায় তারা দু’জন (প্রিন্স ও শাপলা) দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার খোলাহাটির ট্যাক্সের হাট এলাকায় অবস্থান করছে। পরে সাদুল্লাপুর থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে গিয়ে আমরা তাদের বাড়িতে নিয়ে আসি।’
মাইদুল ইসলাম প্রিন্স জানান, কয়েকজন সাদা পোশাক পরা লোক শুক্রবার রাত আনুমানিক একটার দিকে তাদের চোখ বাধা অবস্থায় মাইক্রোবাসযোগে একটি ফাঁকা জায়গায় (পরিত্যক্ত অনাবাদি জমি) নামিয়ে দেয়। পরে তাদেরকে বলা হয়, ‘সামনের সড়কে তোমার মোটর সাইকেল ( সুজুকি ১৫০ সি সি) রাখা আছে। ওটি নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাও।’
শফিউল ইসলাম শাপলা জানান, প্রিন্সের গায়ের উপর তাকে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু তখনও তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, তারা মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরবেন। তিনি আরো বলেন, “মনে মনে ভাবছিলাম হয়তো সেখানেই আমাদের গুলি করে শেষ করে দেওয়া হবে। আটক অবস্থায় একাধিকবার আমাদেরকে বলা হয়েছে—‘গোসল করে তওবা কর, নামাজ পড়।
তোদের আয়ু শেষ।’ কিন্তু ভয়ে আমরা গোলস করিনি।’ তিনি বলেন, ‘মনে মনে বললাম মরতেই যদি হয় তবে গোসল এখানে নয়। বাড়িতেই শেষ গোসল দিয়ে কবর দেবে।’ শাপলা বলেন, ‘যখন দেখলাম আটককারীদের মাইক্রোবাসটি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে, তখন তাকিয়ে দেখি সামনের সড়কে আমাদের মোটরসাইকেলটি দেখা যাচ্ছে।’
প্রিন্স আরো জানান, তারা দুজন মোটর সাইকেলযোগে কিছুদূর গেলে পার্বতীপুরের খোলাহাটির ট্যাক্সেরহাট এলাকায় পৌঁছান। সেখানে অসুস্থবোধ করলে বড় ভাই নয়ন চেয়ারম্যানকে ফোন করেন। পরে নয়ন মাইক্রোবাস নিয়ে রাত ৩টার দিকে তাদেরকে বাড়ি নিয়ে আসেন।
এর আগে বাড়ি ফিরে উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি মনোয়ারুল হাসান জীম মণ্ডল বলেন, সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কয়েকজন তাদের তুলে নিয়ে যায়। তাদের দু’জনকে একটি ঘরে রাখা হয়। খাওয়া-দাওয়া দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘কোন স্থানে ছিলাম, কারা তুলে নিয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি। গত বুধবার রাত পৌনে ১২টার দিকে আমাদের দু’জনকে একটি মাইক্রোবাস থেকে একটি মহাসড়কের পাশে নামিয়ে দিয়ে বলা হয়,
পেছনের দিকে তাকাবি না, তাকালে সমস্যা হবে। ওইখানে তোদের মোটরসাইকেল আছে, সোজা বাড়ি চলে যাবি। পরে মোটরসাইকেলে যাত্রা শুরু করি। কিছু দূর এসে আমরা নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরে পৌঁছাই। সেখান থেকে আমরা দু’জনে মোটরসাইকেলে করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। বৃহস্পতিবার ভোরে সাদুল্লাপুরে পৌঁছাই।’
জীমের সঙ্গে ফিরে আসা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাদেকুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা কারা, কেন আমাদের তুলে নিয়ে এসেছেন—আমরা এমন প্রশ্ন করেছিলাম, কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেননি।’ তবে যেভাবে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটা সাধারণ কোন মানুষের কাজ না বলেই মনে করেন সাদেকুল ইসলাম। তার মতে, এটা কোন বিশেষ বাহিনীর কাজ।
সাদুল্লাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফরহাদ ইমরুল কায়েস জানান, তিনি ওই চারজনের ফিরে আসার কথা শুনেছেন। কিন্তু কারা নিয়ে গেল, আবার ছেড়ে দিল—সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নয়। এসব বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানান।
এমপি লিটন হত্যার পর জেলায় অতিরিক্ত পুলিশসহ একাধিক আইনশৃংখলা বাহিনী তদন্ত কাজে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় গত ৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০ টার দিকে মনোয়ারুল হাসান জীম মণ্ডল ও সাদেকুল ইসলাম সাদেক লালবাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে নলডাঙ্গা রওনা হন। এরপর থেকে তারা মোটরসাইকেলসহ নিখোঁজ ছিলেন। পরদিন ১০ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে নলডাঙ্গা কাচারিবাজার এলাকা থেকে শফিউল ইসলাম শাপলাকে ও বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নলডাঙ্গা রেলগেট এলাকা থেকে মাইদুল ইসলাম প্রিন্সকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেলসহ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।