• মঙ্গলবার , ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

গোল্ডেন মনিরের জাদু-৮ কেজি সোনা বৈধ-র‍্যাবের মামলায় খালাস সেই মনির


প্রকাশিত: ৯:৪৬ পিএম, ৭ মে ২৪ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১১২ বার

 

লাবণ্য চৌধুরী : অস্ত্র আইনের মামলার পর এবার বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা ৮ কেজি সোনার মামলা থেকেও খালাস পেলেন মনির হোসেন ওরফে ‘গোল্ডেন’ মনির। ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ তেহসিন ইফতেখার এ রায় দেন।
সোনা ও টাকা উদ্ধারের ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলাটি করা হয়েছিল। মামলার রায়ের তথ্য বলছে, বাড্ডায় মনিরের বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে র‍্যাবের জব্দ করা ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, আট কেজি সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে অর্জিত। রাষ্ট্রপক্ষ মনিরের বিরুদ্ধে আনা বিশেষ ক্ষমতা আইনের অভিযোগ প্রমাণে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

রায়ের বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী আশরাফুল করিম দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, মনির আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পেয়েছেন। অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. মাহবুবুর রহমান দাবি করেন, রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনি দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, মামলাটিতে একজন পুলিশ কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি মনিরের সম্পদের মালিকানা যাচাইয়ের পর আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছেন, মনিরের বাসা ও প্রতিষ্ঠান থেকে র‍্যাবের জব্দ করা সম্পদ বৈধ।

রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাসায় ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে মনিরকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। সে সময় একটি বিদেশি পিস্তল, ৪ লিটার বিদেশি মদ, ৩২টি নকল সিল, ৮ লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রা, বিপুল স্বর্ণালংকার ও ১ কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করার কথা জানানো হয়। এ ঘটনায় অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে বাড্ডা থানায় তিনটি মামলা করা হয়েছিল র‍্যাবের পক্ষ থেকে। পরে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে আরেকটি মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মনিরের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা করেছিল।

র‍্যাবের তিন মামলার মধ্যে অস্ত্র মামলায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি মনিরকে খালাস দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক মো. আসাদুজ্জামান। গত রোববার খালাস পেয়েছেন বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায়। র‍্যাবের করা মাদক মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। সিআইডির মামলা তদন্তাধীন, দুদকের মামলাটি বিচারাধীন।

সোনা ও টাকা উদ্ধারের পর র‍্যাবের করা মামলার রায়ে আদালত দুজন স্থানীয় সাক্ষী নিরাপত্তাকর্মী মোবারক হোসেন এবং ওষুধের দোকানদার এমাদ উদ্দিনের জবানবন্দির তথ্য তুলে ধরেছেন।সাক্ষী এমাদ উদ্দিন আদালতকে বলেছিলেন, ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টা বা ১০টার দিকে র‍্যাবের কয়েকটি গাড়ি আসে। এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাঁকে মনিরের বাসায় যেতে বলেন র‍্যাব সদস্যরা। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে মনিরের বাসায় বসা অবস্থায় সাদা কাগজে তাঁর সই নেন র‍্যাব সদস্যরা। তাঁকে ১১ ঘণ্টা মনিরের বাসায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল।

মোবারকও আদালতকে বলেন, তাঁর কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নেওয়া হয়েছিল।মামলাটির আরেক সাক্ষী আবদুল হামিদ ছিলেন মনিরের গাড়ি বিক্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক। তিনি আদালতকে বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে র‍্যাব সদস্যরা বিক্রয়কেন্দ্রে যান। পরে সেখান থেকে দুটি গাড়ি (নিশান কার) নিয়ে যান তাঁরা। জোর করে সাদা কাগজে তাঁর একটি সইও নেওয়া হয়।
বিক্রয়কেন্দ্রের আরেক কর্মী আবুল কালামও আদালতকে বলেন, তাঁকেও সাদা কাগজে সই করতে বলা হয়।

ওষুধের দোকানিসহ পাঁচজন সাক্ষী রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগকে সমর্থন করেননি বলে উল্লেখ করে রায়ে আদালত বলেন, অথচ এই পাঁচ সাক্ষীকে রাষ্ট্রপক্ষ বৈরী সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করেনি। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে আদালত রায়ে বলেন, ‘সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তল্লাশি করাকে কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং তাঁদের অবশ্যই পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত পুরো তল্লাশির প্রত্যক্ষদর্শী হতে হবে। প্রতিটি জিনিস কোথা থেকে পাওয়া গেল, তা স্পষ্টভাবে দেখতে সক্ষম হতে হবে।’

রায়ে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করে আদালত বলেন, আইনের বিধানগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ ছাড়া কোনো তল্লাশি বা জব্দ করা বেআইনি বলে গণ্য হবে। ওষুধের দোকানদারসহ পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে তাঁরা র‍্যাবের তল্লাশির প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী না। কোথা থেকে আলামত জব্দ করা হয়েছে, তা তাঁরা দেখেননি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (তৎকালীন ডিবির পরিদর্শক) আবদুল মালেক সাক্ষী হিসেবে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, মামলার এজাহারে ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০ সালের ২১ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট। আর বাড্ডা থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে পরদিন (২০২০ সালের ২২ নভেম্বর) সকাল ৬টায়। অভিযান শেষে এবং এজাহার দায়েরের মধ্যবর্তী সময়ে আসামি মনির কোথায় অবস্থান করেন, সেটি তিনি বলতে পারবেন না। আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, মামলা দায়েরের বিলম্ব এবং জব্দ তালিকা প্রস্তুতির সময়ের ব্যাখ্যা সাংঘর্ষিক ও সন্দেহযুক্ত।

রায়ে সাফাই সাক্ষ্য দেন বেসরকারি দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের দুজন সাংবাদিক। তাঁদের একজন বলেন, ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টার সময় মনিরের বাসায় র‍্যাবের অভিযান চলে। পরদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে র‍্যাবের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

আরেক টেলিভিশন সাংবাদিক আদালতকে বলেন, র‍্যাবের অভিযানের সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সরাসরি সম্প্রচার করেছিলেন। তখনকার প্রচারিত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন তিনি।মামলার এজাহারে র‍্যাব ঘটনার সময় উল্লেখ করেছিল সকালে। তবে কয়েকজন সাক্ষী আদালতকে বলেন, ঘটনার সময় ছিল রাতে। ঘটনার সময় নিয়ে এজাহার ও সাক্ষীদের বক্তব্যের বৈপরীত্যের বিষয়ে আদালত রায়ে বলেন, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও আদালতে উপস্থাপিত দালিলিক প্রমাণ মামলার এজাহার ও রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যের সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রায়ে আদালত জব্দ করা সোনা ও টাকা মনিরকে ফেরত দিতে আদেশ দেন।

মনিরের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সোনা, টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধারের বিষয়ে র‍্যাবের মামলায় বলা হয়, এসব সম্পদ অবৈধ। মনির বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করেছিলেন চোরাচালানের মাধ্যমে।তবে আদালতের নির্দেশে বাড্ডা থানার তৎকালীন পরিদর্শক আবদুর রউফ মনিরের সম্পদ যাচাই করে গত বছরের ৬ জুলাই একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। তিনি আদালতেও সাক্ষ্য দিয়েছেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আয়কর নথি যাচাই করে তিনি দেখেছেন, জব্দ করা সোনা ও টাকা মনির ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের। সোনা ও টাকার কথা মনির, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে এবং তাঁর মায়ের আয়কর নথিতে উল্লেখ রয়েছে।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে র‍্যাবের উদ্ধার করা সম্পদের বিষয়ে রায়ে আদালত বলেছেন, আলামত যাচাই প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, মনিরের বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে জব্দ করা ১ কোটি ৯ লাখ টাকা গাড়ি বিক্রির অর্থ। মনিরের আয়কর নথিতে ঘোষণা দেওয়া রয়েছে, তিনি নগদ ও ব্যাংকের ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা রাখতে পারবেন। বিদেশি মুদ্রার তথ্য মনির ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্টে উল্লেখ রয়েছে।

রায়ে বলা হয়েছে, বাড্ডা থানার পরিদর্শক আবদুর রউফের জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মনির একজন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক। তিনি জাপান থেকে গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করে থাকেন। মনির হোসেন ১৯৮৯ সাল থেকে নিয়মিত আয়করদাতা। তিনি একটি আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকও।

এর আগে মনিরকে গ্রেপ্তার করার পর র‍্যাবের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী ছিলেন মনির। বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরাচালানকারীদের সঙ্গে জড়িয়ে মনির পরিচিতি পান ‘গোল্ডেন মনির’ নামে। বিক্রয়কর্মী থেকে চোরাচালানকারীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পর মনির শুরুতে কর ফাঁকি দিয়ে পোশাক, প্রসাধন, ইলেকট্রনিক পণ্য, কম্পিউটারসামগ্রীসহ বিভিন্ন মালামাল আনা-নেওয়া করতেন। পরে ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে মনির অসংখ্য প্লটের মালিক হন।

পরে র‍্যাবের করা অস্ত্র ও সোনা উদ্ধারের মামলা দুটি তদন্ত করে পুলিশ। সোনা ও টাকা উদ্ধারের মামলায় মনিরের খালাস পাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।