গো.আযম-পুত্রের হুংকার= বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ গালমন্দ
মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত অপরাধী গোলাম আযমের আমৃত্যু কারাভোগের সাজা কার্যকর হলেও তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া এবং মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী ও কামারুজ্জামানের মামলার রায়-পরবর্তী ঘটনাগুলো নিয়ে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
মৃত্যুর পর গোলাম আযমের জানাজার জন্য দুদিন সময় নিয়ে সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী-ক্যাডারদের ঢাকায় নিয়ে এসে যে ‘গ্র্যান্ড শো’ আয়োজন করা হলো, তাতে জামায়াতের শক্তিমত্তা সম্পর্কে জনগণের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
এরপর গোলাম আযমের পুত্র সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আজমী যখন জানাজায় অংশগ্রহণ না করায় বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে গালমন্দ করে ‘জামায়াত-শিবিরের সহায়তা ছাড়া অতীতেও কখনো বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারত না এবং ভবিষ্যতেও পারবে না’—এই সত্যটি তুলে ধরেন তখন তা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির মেরুকরণের রূঢ় বাস্তবতারই পথনির্দেশ করছে। বিএনপি এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি যে একে অপরের পরিপূরকে পরিণত হয়েছে, তা-ই ফুটে উঠেছে আজমীর ওই ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায়।
যে বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে এ দেশে জামায়াত-শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যাদের বদান্যতায় জামায়াতি নেতারা সরকারে আসীন হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের এভাবে শাসানো চরম ধৃষ্টতা। কিন্তু যে বাস্তবতার কারণে এতখানি ঔদ্ধত্য দেখানো সম্ভব হচ্ছে তা হলো, বিএনপির জনপ্রিয়তা থাকলেও সংঘাতমূলক রাজপথের রাজনীতির মাধ্যমে দেশ অচল করে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। ওটার জন্য জামায়াত-শিবিরের ‘সিভিল আর্মি’কে মাঠে নামাতে না পারলে বেগম জিয়ার তাবৎ হুমকি-ধমকি মাঠে মারা যাবে।
অন্যদিকে বিএনপির কাঁধে সওয়ার হতে না পারলে জাতীয়, উপজেলা কিংবা স্থানীয় যেকোনো নির্বাচনে জামায়াত-শিবিরের লজ্জাজনক ভরাডুবি শুধু ক্যাডার-শক্তি দিয়ে ঠেকানো যাবে না। কারণ, ক্যাডার-শক্তির বাইরে জামায়াতের ভোটব্যাংক দেশের কয়েকটি ‘প্রত্যন্ত পকেট’ ব্যতিরেকে অন্যত্র নেহাত অকিঞ্চিৎকর। ১৯৯৬ সালের জুনে নিজেদের শক্তি যাচাই করতে গিয়ে বিএনপি থেকে পৃথকভাবে নির্বাচন করে ধরা খেয়েছিল জামায়াত, ওই শিক্ষা তারা এত তাড়াতাড়ি ভুলবে না।
অতএব, অদূর ভবিষ্যতের প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপির ঘাড়ে সিন্দবাদের দৈত্যের মতো সওয়ার থাকবে জামায়াত। তবে তাদের ক্যাডার-শক্তির ওপর বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের সফলতা নির্ভর করার ব্যাপারটি প্রমাণিত হওয়ার পর এই ক্যাডার-শক্তি বিএনপির সেবায় নিয়োজিত করা হবে কি না তা নিয়ে জামায়াত-শিবির যে বারবার বিএনপির সঙ্গে কঠিন দর-কষাকষিতে লিপ্ত হবে, তাতে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আজমীর হুংকারের আসল মরতবা এখানেই নিহিত।
অবশ্য যুক্তির খাতিরে মানতেই হবে যে প্রকৃতপক্ষে জামায়াত-শিবিরেরই বিএনপির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকা উচিত। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ দোসর ও গণহত্যায় ঘাতকের ভূমিকা পালনের জন্য জনগণের ঘৃণার পাত্র এবং সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধঘোষিত জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘকে ভিন্ন নামে এ দেশে রাজনীতি করার লাইসেন্স দিয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ জিয়াউর রহমানই।
রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য এহেন জাতিদ্রোহী অপকর্ম অনেক করেছেন তিনি। পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, এ দেশে সব ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক অপশক্তির রাজনীতি করার অধিকার ১৯৭২ সালের সংবিধানে রহিত করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলকারী খোন্দকার মোশতাক কর্তৃক সংবিধান স্থগিত হওয়ার সুযোগে ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত ‘রাজনৈতিক দলবিধি আদেশ’ ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে এ দেশে পুনর্বাসিত করেছে।
ওই দলবিধি অনুসারেই ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামে ১৯৭৭ সালে আত্মপ্রকাশ করেছিল জামায়াতে ইসলামী, মওলানা আবদুর রহীম ছিলেন যার প্রকাশ্য নেতা। ওই দলের ছাত্রসংগঠন হিসেবে পুনর্জন্ম লাভ করেছিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যার প্রথম সভাপতি হিসেবে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে প্রকাশ্যে এসেছিল ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত
একাত্তরের কুখ্যাত ‘ডালিম হোটেলের কসাই’ নামে পরিচিত মীর কাসেম আলী। এরপর ১৯৭৮ সালে ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ হিসেবে স্বরূপে কার্যকলাপ শুরু করতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি দলটিকে, ভারপ্রাপ্ত আমির হয়েছিলেন আব্বাস আলী খান। প্রকাশ্যে নেতা যে-ই হোক, পুনর্বাসনের পর্ব থেকেই দলটি যে গোলাম আযমের প্রত্যক্ষ নির্দেশে পরিচালিত হতো সে সত্যটি আবারও পরিস্ফুট হয়েছে আজমীর বিষোদ্গারের মাধ্যমে।
কিন্তু যে কথাটি তিনি চেপে গেছেন তা হলো, তাঁর পিতা তখনো পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে সক্রিয়ভাবে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের জন্য মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গোলাম আযমের মৃত্যুতে শোকাভিভূত পাকিস্তানের বিভিন্ন নেতার প্রশংসাবাণীতে এহেন সার্টিফিকেটের বাণ ডেকেছে গত কয়েক দিন ধরে, যা তাঁর আমরণ পাকিস্তানি সত্তার ব্যাপারটাকে আরও মজবুতভাবে প্রমাণ করে চলেছে।
এরপর জিয়াউর রহমানের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে ১৯৭৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখতে আসার নাম করে পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসে জামায়াত-শিবিরের হাল ধরেছিলেন গোলাম আযম।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের জবানিতে তাঁর পিতার একতরফা প্রশংসামূলক বয়ান পড়ে আমার যে প্রবল মনোবেদনা সৃষ্টি হয়েছে তার মূল কারণ হলো, এই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণকারী একজন সৈনিক।
গোলাম আযমের বিচারের সময় সাক্ষ্য প্রদানকালে এবং মৃত্যু-পরবর্তী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় এখনো তাঁকে পিতার ভূমিকার অনুমোদনকারীর আদলেই দেখা গেল! এ ধরনের ব্যক্তিরা যদি এ দেশের সেনাবাহিনীর এত উঁচু পদে পৌঁছে যেতে পারে তাহলে আমাদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে বৈকি।
শঙ্কার মূল বিষয়ই হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া এ দেশের সেনাবাহিনীকে বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির শাসনামলে কীভাবে এতখানি পাকিস্তানবান্ধব এবং মুক্তিযুদ্ধবিস্মৃত করে ফেলা হয়েছিল?
এ কথা সর্বজনবিদিত যে জিয়াউর রহমানের বিএনপি এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি এ দেশের রাজনীতিতে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীগুলোকে শুধু ছত্রচ্ছায়া প্রদান করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের প্রত্যক্ষভাবে লালন-পালন করেছে।
কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল ঠিকই জানে, ওই দল দুটির শাসনামলে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও জামায়াত-শিবিরের মদদদাতার ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। এটার ব্যাখ্যা কী? আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত মার্কিনিদের যুদ্ধে ‘মুজাহিদ’ জোগানোর ঠিকাদারি নিয়েছিল
বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী এবং আরও কয়েকটি ধর্ম বেসাতিকারী দল। তাই মার্কিন প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থেই কি এ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ওভাবে অপব্যবহার করেছিলেন ওই সামরিক শাসকেরা? একটা সিভিল আর্মির আদলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চালানো শুরু হয়েছিল ওই আশির দশকেই, যে প্রশিক্ষণের অন্যতম অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড় ও জঙ্গলাকীর্ণ ক্যাম্পাস।
১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে এবং তারপর সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়টি আমি জাতিকে জানিয়েছিলাম। দেশের সব পত্রপত্রিকায় ওই খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিতও হয়েছিল, কিন্তু এরশাদ সরকারের কিংবা কোনো বিরোধী দলের টনক নড়াতে পারিনি।
এর কিছুদিন পর ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর এরশাদের লালিত ছাত্রসংগঠন ‘জাতীয় ছাত্রসমাজের’ আবদুল হামিদের হাতের কবজি কেটে সেটা ছুরির আগায় গেঁথে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের জঙ্গি মিছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিংবা এরশাদের সরকার এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এর রহস্য কী?
ওই শক্তি প্রদর্শনের খেলায় জয়লাভের মাধ্যমেই শিবিরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, যে আধিপত্যকে হটানো যায়নি শেখ হাসিনার দুদফার প্রায় ১১ বছরের শাসনের সময়েও। তারপর, একে একে ঢাকার বাইরে অবস্থিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের তাণ্ডবের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে গত তিন দশকে। জামায়াত-শিবির এই তিন দশকে শক্তি সঞ্চয় করতে করতে পুরোদস্তুর একটি জঙ্গি বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরের এহেন তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছে সারা দেশের জনগণ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর গত ১০ মাস রহস্যজনকভাবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে ভাটার টান পরিলক্ষিত হয়েছে।
সাঈদীর আপিলের রায় প্রদানে বিলম্বের পর ফাঁসির রায় আমরণ কারাবাসে রূপান্তরিত হওয়ার ব্যাপারটায় যাঁরা ‘গোপন সমঝোতা’র গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না। একই ধারাবাহিকতায় নিজামীর মামলার রায় গত ২৮ অক্টোবর ঘোষিত হলো, সঙ্গে সঙ্গে তিন দিনের হরতাল দিল জামায়াত।
কট্টর সন্দেহবাদীদের তত্ত্ব, অভূতপূর্ব এই কঠোর কর্মসূচি সমঝোতার গুজবকে উড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চাণক্য-চালও হতে পারে! হরতালের মধ্যেই ঘোষিত হলো মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায়, একদিন হরতাল বাড়ল। ওই হরতালের দিন বিকেলেই বলা হলো, পরদিন কামারুজ্জামানের আপিলের রায় ঘোষিত হবে।
৩ নভেম্বর ঘোষিত হলো, কামারুজ্জামানের আপিল খারিজ। অতএব তাঁর ফাঁসির রায় বহাল। মাঝখানের একটা দিন বুধবারও হরতাল দিল জামায়াত। পুরো নয় দিন হরতালের চক্রে পড়ে গেল জাতি। ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষ থেকে প্রচার চলেছে, সমঝোতার গুজব ‘বোগাস’।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার ব্যাপারে শতভাগ আন্তরিক।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।