গুরুতর অপরাধে জড়িত সাকিব নিষিদ্ধ ৬ মাস
সাকিবের শাস্তির পেছনে ‘গুরুতর অপরাধে’র ভূমিকা থাকলেও সভাপতি সেসব খুলে না বলেই সাকিবের শাস্তি ঘোষণা করেছেন।নাজমুল হাসান বলেছেন, সাকিবের বিরুদ্ধে তাঁদের কাছে অভিযোগ আছে আরও, ‘আপনাদের শুধু কয়েকটা কথা বলছি। সমস্যা অনেক। সব কথা আপনাদের আমরা বলতে পারছি না।’ পরে আবার বলেছেন, ‘তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো শুনেছি…কতগুলো এত অমানবিক মনে হয়েছে আমার কাছে, যেগুলো আমি বলব না আপনাদের সামনে। এত অমানবিক মনে হয়েছে যে আমরা অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। কীভাবে একটা মানুষ এমন করতে পারে!’
দেড় বছর বিদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা বন্ধ
শাস্তি হতে পারে তা অনুমান করাই যাচ্ছিল। তবে সেটা যে এতটা কঠিন হবে, তা বোধ হয় সাকিব আল হাসান নিজেও কল্পনা করেননি। সাম্প্রতিক কিছু শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনাকে সামনে এনে বিসিবি কাল বাংলাদেশের এযাবৎকালের সবচেয়ে সফল ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে আগামী ছয় মাসের জন্য ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক সব ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট থেকে বহিষ্কার করেছে।
এ ছাড়া ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরের কোনো লিগে খেলার জন্য সাকিবকে অনাপত্তি-পত্র না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের গতকালের সভায়। বাতিল করা হয়েছে ইতিমধ্যে দেওয়া সব অনাপত্তিপত্র। এ ছাড়া ভবিষ্যতে আবারও একই রকম শৃঙ্খলাভঙ্গ করলে আজীবন বহিষ্কার করা হতে পারে বলেও হুঁশিয়ার করা হয়েছে সাকিবকে। শাস্তির সময়ে সাকিব অবশ্য বিসিবির সব অনুশীলন-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
শাস্তির ব্যাপারে সাকিব তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেননি। তবে বোর্ড সভা শুরুর আগে সভাপতি নাজমুল হাসানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন তিনি, একই সঙ্গে দুঃখ প্রকাশও করেছেন নিজের ভুলের জন্য। তার পরও বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক সাফল্যগুলোতে যাঁর সবচেয়ে বড় অবদান, সেই সাকিবকে কয়েকজন বোর্ড পরিচালকের উপস্থিতিতে মাত্র ঘণ্টা খানেকের একটি বোর্ড সভায় এত কড়া শাস্তি প্রদান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক ক্রিকেটাররা। ক্রিকেট পরিচালনা কমিটির মতামত না নিয়ে ও শৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে কোনো শুনানি না করেই শাস্তি দেওয়ায় এর প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক বোর্ড পরিচালক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বলেছেন, ‘সামগ্রিকভাবে সিদ্ধান্তটা একটু তাড়াহুড়ো করে নেওয়া হলো।’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াও পছন্দ হয়নি তাঁর, ‘বোর্ডের উচিত ছিল পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া। শৃঙ্খলা কমিটির বক্তব্যও তারা নিতে পারত। অভিযুক্তের বক্তব্য শোনাও প্রয়োজন ছিল মনে করি।’ শাস্তিটা বেশি হলো কি না, এই প্রশ্নে গাজী আশরাফ বলেছেন, ‘সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের মুখ। আন্তর্জাতিকভাবে ওর একটা শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ তার সেরা ক্রিকেটারকে খেলার বাইরে ছিটকে দিল। খেলার ওপর এতটা কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি না করে হয়তো অন্যভাবেও শাস্তি দেওয়া যেত।’ গাজী আশরাফ আরও যোগ করেছেন, ‘সাকিবের বিষয়টা এমন নয় যে বোর্ডসভায় কিছু সময় আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। এটা সামগ্রিকভাবে অনেক দিক বিবেচনা করে নেওয়া যেত। সেরা সিদ্ধান্ত আমরা নিলাম কি না, এ নিয়ে আমার মনে সংশয় আছে।’
বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের কালকের সভার আলোচ্যসূচিতে আরও কিছু বিষয় থাকলেও আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিলেন সাকিব আল হাসানই। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান শাস্তি প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘তার (সাকিব) বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা বেশ লম্বা। বোর্ড মনে করে তার বিরাট আচরণগত সমস্যা আছে। বোর্ড সভায় যাঁরা ছিলেন তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এর আগে এ রকম কাউকে পাওয়া যায়নি।’ সভাপতির দাবি, সাকিবের আচরণগত সমস্যা দলের অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছিল, ‘ওর আচরণ দলে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। অন্য অনেকেই ওর মতো করা শুরু করেছে। যেটা আমাদের ক্রিকেটের সর্বনাশ ডেকে আনছে। সে জন্য বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে মনে করেছে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত।’ সাকিবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ নিয়ে বোর্ডের পক্ষ থেকে অন্যান্য খেলোয়াড় এবং কোচের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। যদিও জাতীয় দলের একাধিক ক্রিকেটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সাকিবের শাস্তি অপরাধের তুলনায় বেশি হয়ে গেছে বলে তাঁরা মনে করেন।
গত এশিয়া কাপে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অশোভন অঙ্গভঙ্গি করায় সাকিবকে তিন ম্যাচের জন্য বহিষ্কার ও তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু গত মাসে ভারত সিরিজেই আবারও তিনি শৃঙ্খলাভঙ্গ করেন ম্যাচ চলাকালে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে। ওই সময় স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করায় মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে এক বখাটে দর্শকের ওপর চড়াও হয়েছিলেন সাকিব। তাঁর বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) যাওয়া নিয়ে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং অনাপত্তিপত্র না নিয়েই সিপিএলে খেলতে চলে যাওয়া।
সিপিএলে খেলতে যাওয়ার বিষয়টি অবশ্য এখন আর অভিযোগ হিসেবে টিকছে না, কারণ বিসিবির নির্দেশে টুর্নামেন্ট না খেলেই সাকিব লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। তা ছাড়া তিনি সিপিএলে গিয়েছিলেন ক্রিকেট পরিচালনা কমিটির প্রধান আকরাম খানের মৌখিক সম্মতি নিয়ে। যদিও কাল অবস্থান বদলে আকরাম খান বললেন, ‘আমি তাকে অনুমতি দিতে পারি না। আমি বলেছি সিইওর সঙ্গে কথা বলে যেতে।’
কোচের সঙ্গে দুর্ব্যবহার প্রসঙ্গে সাকিবের দাবি, ভুল স্বীকার করে পরে কোচের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। কাল সংবাদ সম্মেলনে বোর্ড সভাপতিও বলেছেন, ‘কোচের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্য সাকিব অনুতপ্ত। লন্ডনে গিয়ে এ জন্য টেলিফোনে সে কোচের কাছে ক্ষমা চেয়েছে।’
নাজমুল হাসান বলেছেন, সাকিবের বিরুদ্ধে তাঁদের কাছে অভিযোগ আছে আরও, ‘আপনাদের শুধু কয়েকটা কথা বলছি। সমস্যা অনেক। সব কথা আপনাদের আমরা বলতে পারছি না।’ পরে আবার বলেছেন, ‘তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো শুনেছি…কতগুলো এত অমানবিক মনে হয়েছে আমার কাছে, যেগুলো আমি বলব না আপনাদের সামনে। এত অমানবিক মনে হয়েছে যে আমরা অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। কীভাবে একটা মানুষ এমন করতে পারে!’ সাকিবের শাস্তির পেছনে এসব ‘গুরুতর অপরাধে’র ভূমিকা থাকলেও সভাপতি সেসব খুলে না বলেই সাকিবের শাস্তি ঘোষণা করেছেন।
সাকিবকে খেলোয়াড় আচরণবিধির কোন ধারায় এসব শাস্তি দেওয়া হলো, পরিষ্কার নয় সেটাও। এ ব্যাপারে বিসিবির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য, ‘খেলোয়াড় আচরণবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়নি। শাস্তি দেওয়া হয়েছে খেলোয়াড়দের সঙ্গে বিসিবির চুক্তির ধারা অনুযায়ী। চুক্তি অনুযায়ী কোনো খেলোয়াড় চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে বোর্ড যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।’ শাস্তির বিরুদ্ধে সাকিব আপিল করতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপিল যে কেউই করতে পারে। তবে সেটা বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেবে বোর্ড।’