গুম-ঋদির আর্তনাদ-বাবা আর আইসক্রিম কিনে দেয় না-
সাইফুল বারী মাসুম : ‘সবার বাবা স্কুলে আসে কিন্তু আমার বাবা আর আসে না। আমাকে কেউ চকোলেট, আইসক্রিম কিনে দেয় না। আমিও বন্ধুদের মতো আমার বাবাকে দেখতে চাই।’ মর্মস্পর্শী কথাগুলো বলছিল মাত্র পাঁচ বছর বয়সী শিশু ঋদি। সে মাতুয়াইল আদর্শ কিন্ডারগার্টেন স্কুলে এবার প্লে-গ্রুপ থেকে নার্সারিতে উঠেছে। ঋদি শুক্রবার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এসেছে তার বাবাকে গুম করার প্রতিবাদ জানাতে।
গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারগুলোকে নিয়ে এই সমাবেশের আয়োজন করে ‘ফ্যাসিবাদ ও সামাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় জোট’।
এসময় পাঁচ বছরের ঋদি তার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন জানায়। ‘ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় জোটের’ সাধারণ সম্পাদক হাসান ফকিহ’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলামের মা হাজেরা বেগম, নয়াগণতান্ত্রিক মোর্চার সভাপতি জাফর হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার মো. শাহীনুরের ভাই মেহেদী হাসান, ক্রসফায়ারে নিহত রামপুরার কায়সার মাহমুদ বাপ্পীর বোন শামসুন্নাহার, বংশালে গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা সোহেলের বাবা শামসুর রহমানসহ অনেকে। এসময় স্বজনহারা পরিবারগুলোর কান্নায় সেখানে শোকাবহ পরিস্থিতির তৈরি হয়।
হাজেরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আপনাদের কাছে আর কিছু চাই না, আমার ছেলেকে ফেরত চাই। আমার ছেলেকে কোথাও পাই না। কত জায়গায় গেছি, কতজনের কাছে ধরনা দিয়েছি। কিন্তু আমার ছেলের খোঁজ কেউ দেয় না।
সমাবেশে ঋদির মা ফারজানা আক্তার বলেন, ‘২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তার স্বামী ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনসহ চারজনকে শাহবাগ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে ধরে নেয়া হয়।’
ওই সময় ফারজানা গর্ভবতী ছিলেন। পরে তার একটি ছেলে হয়েছে। ছেলের বয়স আড়াই বছর। তিনি এখন বাবার বাড়িতে থাকেন। তিনি জানেন না তার দুই সন্তানের বাবা বেঁচে আছে না মরে গেছে। স্বামীর সন্ধান চান ফারজানা।
শাহীনুরের ভাই মেহেদী হাসান বলেন, তার ভাইয়ের নামে দেশের কোনো থানায় মামলা দূরে থাক একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পর্যন্ত ছিল না। তারপরও র্যাব সম্পূর্ণ অন্যয়ভাবে তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।’
তিনি বলেন, ভাইয়ের হত্যার বিচার চেয়ে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে মামলা করেছেন। মামলার রায় দেয়ায় দুই ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারিক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন। হাইকোর্টে শুনানির তালিকায় তার রিট আবেদনটি আসলেও বার বার রহস্যজনক কারণে সেটি পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মেহেদী হাসান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিতো ভাই হারানোর যন্ত্রণা জানেন। আপনি কেন কিছু অসৎ র্যাব কর্মকর্তার পক্ষ নিয়ে আমাদেরকে ন্যায়বিচার বঞ্চিত করছেন।’
সমাবেশে কায়সার মাহমুদ বাপ্পীর বোন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে আমার ভাই বাপ্পীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। তিনি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার দাবি জানান।’
সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশে আইন আছে বিচার ব্যবস্থা আছে। অথচ নাগরিকরা হারিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে মর্গে, হাসপাতালে, জেলখানায়, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যালয়- কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন তাদের স্বজন অপেক্ষায় থাকে কখন ফিরবে তার স্বজন। কিন্তু তাদের কোনো হদিস মিলছে না।
এসময় দেশের একজন নাগরিকও যাতে আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের শিকার না হয় সেই দাবি জানান তারা।