• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

গুম উধাও-আবু বকর ফিরলেন,চার বছরে গুম ১৮৭ জন,তোকে মেরে ফেললে টাকা পাব না, ছেড়ে দিলে টাকা পাব’


প্রকাশিত: ১:৩৫ এএম, ১৯ এপ্রিল ১৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৮১ বার

‌তোকে মেরে ফেললে টাকা পাব না, ছেড়ে দিলে টাকা পাব’

কামাল হোসেন প্রধান: ‘তোকে মেরে ফেললেও লস, ছেড়ে দিলেও লস। তবে তোকে ছেড়ে দিলে মাসে মাসে টাকা পাব। তার চেয়ে তোকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।’ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে ছেড়ে দেওয়ার আগে অপহরণ চক্রের বড়ভাই (দলনেতা) একথাগুলো বলছিলেন।

শুক্রবার বিকেলে ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডের ৫৭/২ বাসায় অপহরণের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবু বকর সিদ্দিক সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, অপহরণ চক্রের লোকজন একজনকে বড়ভাই সম্বোধন করে কথা বলছিল। তাদের ভাই পরিচয়ে একজন আসে। সেই বড়ভাই বুধবার রাত ১০টার দিকে প্রথম আমার সঙ্গে কথা বলে। সে জানতে চায় আমি কোথায় চাকরি করি, কত টাকা বেতন পাই। আমি তার সঙ্গে কথা বলে জানতে চাই কোনো টাকা পয়সা চান কিনা? তাহলে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলি?

এ সময় সে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে কথা বলবে বলে চলে যায়। সে চলে যাওয়ার পর যে দুইজন আমাকে বাসায় পাহারা দিত তারা আমার কাছে জানতে চায়, ‘আপনি এমন কে যে আপনাকে নিয়ে মিডিয়া এতো মাতামাতি করছে?’ কিন্তু আমিতো জানতাম না আমাকে নিয়ে রিজওয়ানা (স্ত্রী) এতো কিছু করছে।

তিনি আরো বলেন, পরদিন (বৃহস্পতিবার) সকালে আমাকে না¯ত্মা দেওয়া হয়। দুপুরে ভাত দেওয়া হয়। রাতে খাবার দেয়, তা খাই।

আবু বকর বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১০ মিনিটের দিকে ওদের বড়ভাই আবার আসে। এসে আমাকে বলে, তোকে তো মেরে ফেললেও লস, ছেড়ে দিলেও লস। তোকে মেরে ফেললে টাকা পাব না, ছেড়ে দিলে টাকা পাব। এরপর ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে আমাকে আবার চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে দেয়। ১ ঘণ্টা গাড়ি চলার পর আমাকে মিরপুরের আনসার ক্যাম্পের কাছে চোঁখবাধা অবস্থায় নামিয়ে দেয়। তারা আমাকে তিনশত টাকা দিয়ে বলে, এটা দিয়ে সিএনজি ভাড়া করে বাসায় যা। এরপর আমি রিকশা নিয়ে কাজীপাড়া আসি। সেখান থেকে একটি সিএনজিতে করে ধানমন্ডির বাসার দিকে আসি। এ সময় ধানমন্ডি ক্লাবের সামনে টহল পুলিশ সিএনজি থামাতে বলে। সেখানে পুলিশকে আমি আমার পরিচয় দিই। এরপর ধানমন্ডি থানায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে।

এর আগে আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের বর্ণনা দিয়ে বলেন, বুধবার বিকেল ২টা ২৫ মিনিটের দিকে নারায়ণগঞ্জের অফিস থেকে ঢাকার বাসায় আসার জন্য রওয়ানা দিই। এ সময় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডে পৌঁছলে পিছন থেকে আমার গাড়িটিকে একটি গাড়ি ধাক্কা দেয়। তখন আমি গাড়ি থেকে নেমে আসি। দেখতে গেলাম গাড়ির কি অবস্থা। এ সময় ওই গাড়ি থেকে পাঁচ থেকে ছয়জন লোক নেমে আসে। আমাকে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে তুলে আমার হাত, পা বেঁধে ফেলে এবং মুখে একটা মাস্ক পড়ানো হয়। তারা ধাক্কিয়ে আমাকে গাড়িতে শুইয়ে দেয়। দেড়ঘণ্টা গাড়ি চলার পর তারা আরেকটি গাড়িতে তোলে আমাকে। এ সময় আমার চোখ বাঁধাই ছিল। তিন ঘণ্টা গাড়ি চলার পর একটি বাড়িতে নিয়ে যায় আমাকে। বাড়িতে নেওয়ার পর সর্বক্ষণই আমার পাহারায় দুইজন লোক থাকত।

অপহরণকারীদের বর্ণনা দিয়ে আবু বকর বলেন, তাদের প্রত্যেকের উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি হবে এবং খুব স্বাস্থ্যবান। তাদের মধ্যে একজনের পরনে খবু ভালো পোশাক ছিল অর্থাৎ ফরমাল ড্রেস।

তিনি আরো বলেন, আমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি ওরা। ওরা আমাকে তেমন কোনো রকম মারধর করেনি, টর্চারও করেনি। বাথরুমে যেতে চাইলে, বাথরুমে যেতে দিত। এ সময় চোখ খোলা হলেও বাথরুমে থেকে বের হতে হত পেছন হয়ে। সামনে হয়ে বের হওয়া যেত না।

আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এই অপহরণের ঘটনা আমাকে আমার কাজ থেকে দূরে রাখার কৌশল হতে পারে। হয়তো বা এমনও হতে পারে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আগামী এক মাস কোনো কাজই করতে পারব না। এজন্য যে আমি ভয় পেয়ে বেলা’র কার্যক্রম গুটিয়ে নেব, এটা হতেই পারে না। ‘

‘এর আগে দেশে যেসব গুম-অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, এই ৩৫ ঘণ্টায় তাদের স্বজনদের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেছি। আগের ঘটনাগুলোর বিচার হলে এ ঘটনা (এবি সিদ্দিকের) ঘটত না। আমি চাইব এটিই হোক শেষ ঘটনা’ যোগ করেন তিনি।

স্বামী অপহরণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মাদ এরশাদ, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সুশীল সমাজ, এনজিও প্রতিনিধি থেকে সম¯ত দেশবাসী যে উদ্বেগ জানিয়েছেন, তার জন্য তাদের প্রতি তিনি ও আবু বকরের পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বিষয়টি তদারক করেছেন। বিভিন্নজনকে নির্দেশনা দিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া নিজে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। সবাই এটিকে নিজের পরিবারের ঘটনা ভেবে তৎপর হয়েছেন। আর এজন্যই আমি আজ সবার সামনে এই উৎফুল্ল চিত্তে বসতে পেরেছি। এটির কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই, আমি সত্যিই আজ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি।’

উল্লেখ্য, বুধবার বিকেল সোয়া ৩টায় আবু বকর সিদ্দিক তার প্রাইভেটকারে করে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। ফতুল্লার ভূইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে আসা মাত্র পেছন দিক থেকে একটি নীল রঙের হাইয়েস মাইক্রোবাস দিয়ে তার গাড়িতে ধাক্কা দেওয়া হয়। এ সময় গাড়ি থামিয়ে আবু বকর ও তার গাড়িচালক নেমে এলে ওই গাড়ি থেকে সাত থেকে আট জন যুবক লাঠিসোটা ও অস্ত্রের মুখে তাকে তুলে নিয়ে যায়।

স্থানীয় সময় : ২২৫৯ ঘন্টা, ১৮ এপ্রিল ২০১৪

 

 

 

গুম উধাও-আবু বকর ফিরলেন,চার বছরে গুম ১৮৭ জন

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আসিফ নজরুল:  শুক্রবার পত্রিকা খুলে পাওয়া গেল পরম আনন্দ আর স্বস্তির একটি সংবাদ। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক (এবি) ফিরে এসেছেন অপহূত হওয়ার ৩৫ ঘণ্টা পর। এই রহস্যময় অপহরণ ঘটনার কোনো কূল-কিনারা অবশ্য এখনো হয়নি। তবু এবি ভাগ্যবান, আমরা যারা এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে ছিলাম, আমরাও ভাগ্যবান যে তিনি সুস্থ অবস্থায় ফিরেছেন তাঁর পরিবারের কাছে। আমাদের মধ্যে যাঁরা চালাক-চতুর বা যাঁরা সরকারের বিভিন্ন সুবিধা নিয়েছেন, তাঁরা এই ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা শুরু করবেন অচিরেই। কিন্তু এবির ফিরে আসার এই আনন্দময় সময়েও আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি এই দায়িত্বে থাকা অবস্থায় গত প্রায় তিন মাসে অপহূত বা গুম হয়েছেন ৩৯ জন। তাঁদের মধ্যে মাত্র চারজন ফিরেছেন জীবিত অবস্থায়, ১২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ২৩ জনের কোনো খোঁজ মেলেনি। গত চার বছরে অপহূত ২৬৮ জনের মধ্যে এভাবে গুম হয়ে গেছেন ১৮৭ জন। এবি সিদ্দিকের ফিরে আসার ছবি দেখে তাঁদের পরিবার কি একটুও আশান্বিত হতে পারে? একবারও কি তাদের মনে হবে, একদিন ফিরে আসবেন তাদের প্রিয়জনও?
গুম বা উধাও হওয়ার ঘটনা অনেক দিন ধরে ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। দেশের বিভিন্ন প্রেসক্লাবের সামনে গুম হওয়া মানুষের ছবি নিয়ে পরিবারের আহাজারির বহু ছবি আমরা দেখেছি। প্রান্তিক পরিবারের মানুষ উধাও হয়েছেন, মফস্বলের যুবক উধাও হয়েছেন, রাজনৈতিক কর্মী উধাও হয়েছেন। আমরা শহরের সুশীল আর সম্পন্ন নাগরিকেরা তাতে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হইনি, রাষ্ট্র এসব গুমের অভিযোগের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি। বরং এমন অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে যে রাষ্ট্র নিজেও এসব গুমের ঘটনায় জড়িত। সরকারের বাহিনী কিছু গুমের ঘটনায় সরাসরি জড়িত—এ ধরনের আলামত-সংবলিত অভিযোগও পাওয়া গেছে। বিচার বিভাগ, মানবাধিকার কমিশন বা কোনো সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তাতে নড়েচড়ে বসেনি। এসব গুরুতর অভিযোগ শুনে আমাদের নাগরিক সমাজেরও রাতের ঘুম হারাম হয়নি।
এবির অপহরণের পর আমাদের চৈতন্যোদয় হয়েছিল। এবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। আমার অনুজপ্রতিম, আমাদের সবার প্রিয় হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত ও নির্বিরোধ একজন মানুষ। তিনি পত্রিকার পাতায় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হয়েছেন কিছুটা হলেও রিজওয়ানার স্বামী হওয়ার কারণে। রিজওয়ানা এ দেশের পরিবেশ আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বহু বছর ধরে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে তাঁর নিরপেক্ষ ও মেধাদীপ্ত উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। রিজওয়ানার সুখ্যাতি, নাগরিক সমাজ আর গণমাধ্যম সোচ্চার হওয়ার ফলে হয়তো তাঁর স্বামী সশরীরে ফিরে আসতে পেরেছেন। কিন্তু এ ঘটনার মধ্য দিয়ে জনজীবনের সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা আবারও যেভাবে ফুটে উঠেছে, তার কোনো সুরাহা হবে কি? বন্ধ হবে কি রহস্যময় অপহরণ, উধাও আর গুমের অসুস্থ আতঙ্কজনক ও নৈরাজ্যকর প্রবণতা?
দুই
গুম বা উধাওয়ের অনেক ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সম্পৃক্ততার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় গুম হওয়া ব্যক্তি আর ফেরত আসেননি। আমরা স্বস্তি পেয়েছিলাম এটি ভেবে যে রিজওয়ানার স্বামীকে সম্ভবত সরকারের কোনো বাহিনী অপহরণ করেনি। আমরা পত্রিকায় সরকারের বিভিন্ন মহলকে বরং উদ্বিগ্ন হতে দেখেছি এ ঘটনায়। রিজওয়ানা নিজেও সরকারের কোনো মহলকে এ ঘটনার জন্য দোষারোপ করেননি। কিন্তু তিনি যাদের দিকে অভিযোগের অঙ্গুলি হেলন করেছিলেন, তারা সরকারের মতোই ক্ষমতাশালী, এক অর্থে তারা সমান্তরাল সরকার। তারা পরিবেশ-সংক্রান্ত রিজওয়ানার বিভিন্ন মামলা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রায় সবাই ‘ভূমিদস্যু’ হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিল। কারও কারও বিরুদ্ধে খুন-খারাবির প্রামাণ্য অভিযোগ রয়েছে। এ দেশের রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা প্রদান করে, ক্ষমতাশালী অন্যান্য মহলকে বশীভূত করে এবং কয়েকটি গণমাধ্যম স্রেফ কিনে নিয়ে তারা এখন সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়েছে। এবিকে যদি সত্যি তারাই অপহরণ করে নাগরিক চাপে পড়ে ফিরিয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় সরকার আনতে পারবে কি না সন্দেহ। শুধু তারা কেন, সমাজের যেকোনো দুর্বৃত্ত (পেশাদার অপরাধী, স্থানীয় গডফাদার, মাদক ব্যবসায়ী, নারী বা শিশু অপহরকারী) এখন খুন-খারাবি, গুম বা অপহরণের মতো অপরাধ করলে তা রোধ করার মনোবল বা সক্ষমতা কি সরকারের আছে?

তিন
গুরুতর ও সংঘটিত অপরাধ দমনের সক্ষমতা ও নৈতিকতা সরকার হারিয়েছে বহুভাবে। এক. বহু গুম বা খুনের ঘটনায় সরকার ও তার বাহিনীগুলো নিজেরা জড়িত ছিল, এমন অভিযোগ থাকলেও তার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি কখনো। সরকারের পছন্দনীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গড়া মানবাধিকার কমিশন পর্যন্ত কয়েকটি গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকারের বাহিনীগুলোর সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছে। দুই. নিজেরা অপরাধ সংঘটন না করলেও অনেক ক্ষেত্রে সরকার গুম বা খুনের ঘটনা তদন্ত বা বিচারে সুস্পষ্ট গাফিলতি বা অনীহা দেখিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুমের ঘটনা সম্পর্কে স্রেফ অজ্ঞতা প্রকাশ করে সরকারের কর্মকর্তারা নিজেদের দায়িত্ব সেরেছেন। সরকারের কোনো অংশ যদি কিছু গুমের ঘটনায় নিজেই জড়িত হয় বা সরকার যদি এসব ঘটনার বিচারে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে এ রকম আরও ঘটনা ঘটাতে অপরাধীরা বহু গুণে আত্মবিশ্বাসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বাংলাদেশেও তা-ই হচ্ছে। এবির অপহরণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে এসব আরও ঘটবে।
এবির মতো আরও যাঁরা উধাও বা গুম হয়েছেন, সেসব ঘটনার সুরাহাও তাই সরকারকে করতে হবে। মানুষের জীবনের এতটুকু মূল্য থাকলে সরকারকে সার্বিকভাবে নাগরিক জীবনে বিরাজমান ভয়ভীতি আর আতঙ্ক দূর করতে হবে। সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে যে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে পুলিশ ও অন্য বাহিনীগুলোকে প্রধানত নিজেদের গদি রক্ষার প্রয়োজনে ব্যবহার করলে, প্রশাসন ও পুলিশের চেইন অব কমান্ড রাজনৈতিক স্বার্থে বিনষ্ট করলে এবং সরকারি দলের অপরাধ সংঘটনকারী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধ দমনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি শুধু নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যও বিনষ্ট হয়, দেশ অপরাধীদের চারণভূমিতে পরিণত হয়। এই অপরাধভূমিতে একদিন না একদিন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে সরকার নিজেই।
চার
আমি আগেও লিখেছি, গুম সবচেয়ে গুরুতর অপরাধগুলোর একটি। গুমের প্রতি সারা বিশ্বের সচেতন মানুষের তীব্র আপত্তি সংগঠিত রূপ নিতে শুরু করেছে অনেক বছর ধরে। গুম থেকে সব মানুষকে রক্ষা করা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক একটি রেজুলেশন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯২ সালে গ্রহণ করে। ২০০৭ সালে এ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি (কনভেনশন) সম্পাদন করা হয়। এই চুক্তিতে গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং যুদ্ধ, জরুরি অবস্থা, চরম রাজনৈতিক বিপর্যয়—কোনো অবস্থাতেই কাউকে গুম করার বৈধতা নেই বলা হয়। ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৪২টি রাষ্ট্র এর পক্ষ হয়েছে, ৯৩টি রাষ্ট্র এটি স্বাক্ষর করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই আন্তর্জাতিক চুক্তিটি অনুসমর্থন তো দূরের কথা, এটি স্বাক্ষরই করেনি বাংলাদেশ (দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত ও মালদ্বীপ এটি স্বাক্ষর করেছে)। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে এই সরকার আগের নির্বাচনের সময় নির্বাচনী ইশতেহারে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এবার গত ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের আগে সেই প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি তারা। এটি হয়তো তাই আশ্চর্যজনক নয় যে নতুন সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েছে, বেড়েছে গুম আর অপহরণের ঘটনাও।
এবিকে উদ্ধারের জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেই তাই আমাদের নাগরিক সমাজকে থেমে থাকলে চলবে না। এই সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব রয়েছে প্রত্যেক মানুষের জীবন রক্ষা করার। সেই দায়িত্ব প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে (সে যে দলেরই হোক, যত দরিদ্র আর ক্ষমতাহীন হোক) পালন করার জন্য সরকারের ওপর নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করার সব পদ্ধতি আমাদের অবলম্বন করতে হবে। দেশের পুলিশ আর প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে দলীয়করণকৃত, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর থেকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল বলে কার্যত কিছু নেই। এই পরিস্থিতিতে বাঁচতে চাইলে নাগরিক
সমাজকে গুম, অপহরণ আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে হবে। এই সরকারের আমলে নিরাপত্তার আশঙ্কা নেই বলে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, গুম করার মতো অন্য বহু শক্তি রয়েছে, আরও বহু শক্তি জন্মাবে ভবিষ্যতে। বাঁচতে চাইলে তাই আমাদের গুম-উধাও আর বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
স্বাধীনতার পর সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছিলেন, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। আওয়ামী লীগ-বিএনপির কুশাসনে এত দিনে আরও অন্ধকার হয়েছে দেশ। আমাদের দুর্ভাগ্য, কিছু পরিবারকে এখন বলতে হচ্ছে, স্বাভাবিক মৃত্যু না হোক, অন্তত সৎকারের গ্যারান্টি চাই। এমন পরিবার একটিও যেন না বাড়ে আর।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।