গাজীপুরে রাস্তা উন্নয়নের নামে জমিদখল ডিসির হস্তক্ষেপ দাবী
গাজীপুর প্রতিনিধি : গাজীপুরে রাস্তা উন্নয়নের নামে ইটাহাটা এলাকার নিরীহ মানুষের জমিদখল করায় এলাকাবাসী মেয়রের ওপর চরম ক্ষুদ্ধ। তারা এ ঘটনায় ডিসির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ উন্নয়ন কাজে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা সরকারী বরাদ্দ পেয়েছে । যে কোন উন্নয়নই একটি সুখকর বিষয়। উন্নয়ন মানেই জনকল্যান। কিন্তু এই উন্নয়ন নিয়ে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে গাজীপুরের বাসন থানাধীন বেশ কয়েকটি এলাকায়। এরমধ্যে গাজীপুরের ইটাহাটা এলাকাটির উন্নয়ন নিয়ে বর্তমানে ভয়াবহ অসন্তোষ বিরাজ করছে।
সেখানে ১০/১২ ফিটের সরু রাস্তা ৪০ ফিট করতে নির্মান কাজ শুরু হয়েছে। এই ৪০ ফিট করতে গিয়ে এলাকার হত দরিদ্রদের জমিজমার মালিকেরা নিজেদের ঘর বাড়ী, ভিটে, গাছপালা, কারখানা, দোকান, পোল্ট্রি, ডেইরী ফার্ম এমনকি অনেকের জীবন জীবিকা অর্জনের একমাত্র অবলম্বনও হারিয়েছে। তাও সীমাহীন নির্যাতন ও বর্বরতার মাধ্যমে। কেউ কেউ নিজেদের শেষ সম্বল বা একমাত্র আশ্রয়স্থলটুকুও হারাতে হয়েছে। সেখানে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার, মৌলিক অধিকার বা সার্বজনীন মানবাধিকারের কোন তোয়াক্কা করা হচ্ছেনা। জোড় জুলুম করে অতর্কিতভাবে পুর্ব অবগতি ছাড়াই হঠাৎ ভেঙ্গে দিয়ে রাস্তা নির্মানের জন্য মানুষের বসতভিটার জমি দখল চলছে। অত্যন্ত বিস্ময়কর হলেও সত্য, ভাংচুর করতে আসা লোকজন কর্তৃপক্ষের কোন অফিসিয়াল নির্দেশনা বা অনুমতি নিয়ে আসেনা।
এলাকার বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম, চান মিয়া, শান্তি মোহন ঘোষ, পারভীন আক্তার, হাজী মো শাহাবুদ্দিন, আনিকা ঘোষ,আবদুল হামিদ, মোশাররফসহ এমন আরো অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে তারা সবাই রাস্তার সম্প্রসারন চায়। কোন উন্নয়ন কর্মকান্ডেরই প্রতিপক্ষ তারা নন। কিন্তু রাস্তার জন্য জমি ছেড়ে যদি মাথা গোজার ঠাইটুকুও না থাকে তবে সেই উন্নয়ন আমাদের কি কাজে আসবে? এদের কেউ কেউ গোয়াল ঘরে থাকছেন। কেউ ভাসমান, কেউ জীবিকা হারিয়েছে। পারভীন বাপের বাড়ী থেকে আড়াই লক্ষ টাকা এনে, ঘর তুলে স্বামী সংসার নিয়ে দিব্যি সুখে ছিলেন। পুরো বাড়ীটাই এখন আর নেই।
গাজীপুরের মেয়র দৃশ্যপটের বাইরে থাকলেও নেপথ্যে তিনিই এসব কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন বলে এলাকাবাসীদের কেউ কেউ মনে করেন। কারন তিনিই নগর পিতা। এলাকাবাসী বিশ্বাস করে, তার নির্দেশনা বা সিদ্ধান্তের বাইরে সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে কোন কিছুই ঘটতে পারেনা। এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং বহু মামলার আসামীদের দ্বারা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ইটাহাটায় ভাংচুর কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। অসহায় নিরীহ মানুষকে নির্মম অত্যাচার মারধোর এমনকি এলাকার নারীদেরকেও শারিরিকভাবে অত্যন্ত বর্বরোচিতভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানান।
এ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থরা একাধিকবার সাংবাদিক সম্মেলন করেছে। প্রশাসনকে অবগত করে শান্তি শৃংখলা রক্ষা ও নিরাপত্তা চেয়েছে। এমন কি স্থানীয় পুলিশকে যথাযথভাবে অবগত করেও তারা কোন আইনী সহায়তা পায়নি বলে তাদের অভিযোগ। জাতীয় সংবাদ মাধ্যম তথা প্রচার বহুল দৈনিক ইত্তেফাক , দৈনিক যুগান্তর, বিডি নিউজ২৪, বাংলা ট্রিবিউন, জাগো নিউজ২৪, ডেইলী বাংলাদেশ, স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলাভিশন, আরটিভি, একাত্তর টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব পৈশাচিক ও নারকীয় বর্বরতার সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। একের পর এক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন সেখানে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। কিন্তু যারাই প্রতিবাদী হয়ে উঠছে, তারা প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত মাস্তানবাহিনী দ্বারা নির্যাতনের শিকারও হচ্ছে।
এমনই এক ঘটনায় বিগত ২৫ অক্টোবর ২০১৭ ইটাহাটা এলাকায় চাঁদা না দেয়ায় একটি পোল্ট্রি ফার্মের গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে ফার্ম মালিকের বাড়িতে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়। ফার্ম মালিক নাসিমা বেগম একটি পত্রিকা অফিসে সংবাদ সম্মেলনে করে জানান, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় পোল্ট্রি ফার্মের ১০-১২ দিন বয়সের সাড়ে ৬ হাজার মুরগীর বাচ্চার অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে চাঁদাবাজদের হুমকিতে পরিবারের লোকজনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। পরবর্তীতে জানা গেছে- নাসিমা তার ফার্মের ১টি মুরগীও বাঁচাতে পারেনি। যেখানে তার ৫ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতিসাধন হয়। উল্লেখ্য, একজন সফল খামারী হিসাবে নোবেল জয়ী ড. ইউনুছও তার খামার পরিদর্শনে এসেছিলেন।
নাসিমা বেগম আরো জানান, তিনি ধারদেনা করে ইটাহাটা এলাকায় নিজ বাড়িতে দর্জির দোকান ও পোল্ট্রি ফার্মের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তার ব্যবসার উন্নতি দেখে স্থানীয় আশরাফুল আলম প্রকাশ রানা মোল্লা ওরফে রানা বদমাস তার লোকজন দিয়ে বিভিন্ন সময় মোটা অংকের চাঁদা দাবি করতো। দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় তারা ফার্মের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ ঘটনায় ওই দিন রাতে জয়দেবপুর থানায় জিডি করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কথিত রানা বদমাস পরদিনই সকালে ভাড়াটে সন্ত্রাসী নিয়ে বাড়িতে ভাঙচুর করে এবং মামলা ও খুন-জখমের হুমকি দিয়ে চলে যায়। জয়দেবপুর থানার এস আই মো. জামাল মিয়া প্রাথমিকভাবে নাসিমা বেগম প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন।
ঘটনার রাতে পুলিশ সাইফুল ইসলাম প্রকাশ সাইফুল মোল্লা নামের একজনকে আটক করলেও স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার তদবিরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নাসিমা বেগম। অপর এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন- ছাত্র জীবনেই এই রানা বদমাস ৮টি মামলার আসামী ছিলো। নাসিমা আরও বলেন, ২০০৫ সালে ও ২০০৬ সালেও ব্যবসায় বাধা দেওয়া ও চাঁদা দাবির অভিযোগে কথিত রানা বদমাস ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জয়দেবপুর থানায় একাধিক মামলা ও জিডি করা হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে এসব মামলা ও জিডি প্রসঙ্গে পুলিশ নিক্রিয় থাকে।
১৫ বছর পরেও এই সংঘবদ্ধ চক্রের দাপট এতটুকু কমেনি বরং রেড়েছে। বর্ণিত রানা মোল্লা এবং সাইফুল মোল্লা ছাড়াও আবুল কাশেম ও আক্কাস পিতা- মৃত তনুর উদ্দিন, ফারুক হোসেন পিতা- আবুল কাশেম, শাহাদাত হোসেন পিতা-ইনুর উদ্দিন, মেরাজ মোল্লাসহ এই সংঘবদ্ধ চক্র বহুদিন ধরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছে।
গত ৮/৮/২০১৯ তারিখের গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এক তদন্ত প্রতিবেদনেও এসব অপরাধীর নাম এসেছে। নাসিমা বেগম ছাড়াও মোঃ সুরুজ মিয়া, মোঃ মনির হোসেন, মোঃ হাফিজুর রহমান, দিলরুবা হোসেন, মোঃ আশরাফুল আলম, মোঃ জুয়েল সরকার, হাজী মোঃ হাসান উদ্দিন, লিটন আহমেদ, মোঃ মতিনসহ আরো অনেকে বিভিন্ন সময় থানা পুলিশ ও গণমাধ্যমকে এসব সন্ত্রাসী চক্র সম্পর্কে অবগত করে আসলেও আজ পর্যন্ত রহস্যজনক কারনে তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
গাজীপুর মেয়রের উন্নয়ন প্রকল্পে বিশাল অংকের অর্থ বরাদ্দ থাকলেও ৪০ ফিট রাস্তা সম্প্রসারনে ক্ষতিগ্রস্থ ও ভিটেমাটি জমি ও শেষ সম্বল, এমনকি কেউ কেউ সর্বস্ব হারালেও কোন ক্ষতিপূরন পায়নি। মেয়র নিজে একজন আইনজীবি হলেও রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারকে কোন তোয়াক্কাই করছেন না। নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসক অধিগ্রহনের মাধ্যমে জমির মালিকদের ক্ষতি পূরন প্রদানের মাধ্যমে জমি বুঝে নেবেন। তা না করে বর্গী ও বৃটিশ বেনিয়াদের মত পেটোয়া বাহিনী দিয়ে অতর্কিত উচ্ছেদ অভিযান করে, ভাংচুর ও দখল করে রাস্তা নির্মান করা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার লংঘনের সামিল। ইটাহাটা এলাকার হত দরিদ্র অসহায় মানুষেরা আজ নির্যাতিত, তারা আইনের শাসন থেকে বঞ্চিত, ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত, পুলিশের সহায়তা থেকে বঞ্চিত, পিতৃ পুরুষের জমিজমা হারিয়ে আজ তারা আজ ভূমিহীন মানুষের কাতারে।
এলাকার ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর খোরশেদ আলম সরকার টেলিফোনে জানান- মানুষের এই দুঃখ দুর্দশার কথা তিনি মেয়র ও জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে অবগত করেছেন। প্রশাসনের প্রতি এই এলাকার মানুষ ক্রমেই বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তাই তারা সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংস্থার দ্বারস্থ হচ্ছে। এ প্রতিবেদকের কাছে তারা উচ্চ আদালতে যাবার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তবে ভুক্তভোগীরা এখনো এব্যাপারে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।