• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

গর্ভভাড়া নিয়ে অনৈতিক বানিজ্যে তোলপাড়


প্রকাশিত: ৪:৩৫ পিএম, ৩ নভেম্বর ১৫ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১০৪ বার

38090

লাবণ্য চৌধুরী:   বিদেশি ক্রেতার কাছে ভারতের গর্ভ ভাড়া দেওয়ার বাজারের দরজা বন্ধ করলে জাতীয়তাবাদের সস্তা রাজনীতিতে লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু আসল তর্কগুলোয় পৌঁছোনো যায় না। নৈতিকতার প্রশ্নটি অমীমাংসিতই থাকে।

কে ন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে, অতঃপর কোনও সন্তানহীন বিদেশি দম্পতি ভারতে এসে গর্ভ ভাড়া নিতে পারবেন না। দেশি দম্পতিদের ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কোনও বাধানিষেধ থাকছে না।সিদ্ধান্তটি নেহাতই অবান্তর। প্রথম কথা, আর কোনও আইনি সংস্কার বা নজরদারির ব্যবস্থা না করে শুধু এই সিদ্ধান্তটি বলবৎ হলে ক্ষতি গর্ভ ভাড়া দিতে চাওয়া মেয়েগুলির— গর্ভ-বিক্রেতাদের। বিদেশি ক্রেতারা অনেক বেশি টাকা দিতে সক্ষম এবং ইচ্ছুক। গর্ভ ভাড়া দেওয়ার বাজারে বিদেশি ক্রেতা না থাকলে ভাড়ার বাজারদর পড়বে।

বলতেই পারেন, বিদেশি ক্রেতারা যেখানে এক বার গর্ভ ভাড়া নিতে ত্রিশ হাজার ডলার অবধি দেন, সেখানে গর্ভ বিক্রেতা মেয়েগুলির হাতে বড় জোর ৭,০০০ ডলার পৌঁছোয়। বাকি টাকাটা দালাল, ডাক্তার, ক্লিনিক-মালিকের পকেটে যায়। কিন্তু, প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও গৃহবধূর পক্ষে কি অন্য কোনও পথে ন’মাসে সাড়ে চার লক্ষ টাকা, উপার্জন করা সম্ভব? কত জন ভারতীয় ক্রেতা এই দামে গর্ভ ভাড়া নিতে পারবেন?

নরেন্দ্র মোদী জাতীয়তাবাদের সস্তা খেলা খেলতে পারেন,  সারোগেসি বা গর্ভ ভাড়া দেওয়া নিয়ে কিন্তু বিতর্ক প্রচুর, এবং তা বহু স্তরে বিস্তৃত। কিছু আপত্তি অল্প কথায় কাটিয়ে দেওয়া যায়। যেমন, একটি প্রচলিত আপত্তি হল, গর্ভ ভাড়া দেওয়ার বাজারটি একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত, ফলে বহু ক্ষেত্রেই গর্ভ-বিক্রেতা মেয়েটি সন্তানধারণের পর বহুবিধ অসুবিধায় পড়ে। গর্ভাবস্থায় যে যত্ন তার প্রয়োজন, তার চূড়ান্ত অভাব, ফলে গর্ভবতী মেয়েগুলির স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেশ চড়া। আবার, সন্তান প্রসবের পর ক্রেতা দম্পতি সেই সন্তান গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন, এমন ঘটনাও খুব বিরল নয়।

এই আপত্তির ভিত্তিতে গর্ভ ভাড়া দেওয়াকে নিষিদ্ধ করার কোনও যুক্তি নেই। সন্তান ধারণের পর গর্ভবতী মেয়েটির যথার্থ চিকিৎসার দায়িত্ব যাতে ক্রেতারা নিতে বাধ্য থাকে, সন্তান প্রসবের পর যাতে সেই সন্তান নিতে অস্বীকার করার উপায় না থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য ঠিক ভাবে নীতি নির্ধারণ করলে, এবং নজরদারির ব্যবস্থা করলেই যথেষ্ট হয়। বস্তুত, বাজার থাকলে যথার্থ নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যবস্থা করাই সরকারের কাজ। বাজারটিকে উঠিয়ে দেওয়া নয়।

টাকায় কি দাম হয়?

মূল প্রশ্ন হল, সারোগেসির ‘বাজার’ কি আদৌ থাকা উচিত? অনিবার্য প্রতিপ্রশ্ন— এমন বাজার থাকবে না-ই বা কেন? টাকার বিনিময়ে মেধা ভাড়া দেওয়া গ্রহণযোগ্য হলে গর্ভ ভাড়া দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয় কেন, এই প্রশ্নের কোনও বস্তুনিরপেক্ষ উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। প্রশ্ন তুলতেই পারেন, মাতৃত্বের দাম কি টাকার অঙ্কে হয়? ভেবে দেখলে, হরহামেশাই এমন সব জিনিস বিক্রি হয়ে চলেছে, টাকার অঙ্কে যার দাম হওয়া উচিত নয়। প্রকৃতি আমাদের দরাজ হাতে যে সব উপহার দিয়েছে, সেই ফুল, ফল, মাটি, খনিজ সম্পদ, এমনকী জল— সবই তো বিক্রি হয়।

কোনও জিনিসের ভ্যালু বা মূল্য এবং প্রাইস বা দাম আসলে দুটো আলাদা ধারণা। বাজার অর্থনীতিতে মূল্য নিয়ে মাথাব্যথা নেই, তার কারবার দাম দিয়ে। যে জিনিসের জন্য কেউ দাম দিতে রাজি, আর কেউ সেই দামে জিনিসটা দিতে রাজি, বাজার সেখানেই কাজ করে। বাজার আসলে মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ একটা ব্যবস্থা।

কিন্তু, তার পরেও প্রশ্ন থাকে। নৈতিকতার প্রশ্ন। যে কোনও বিনিময়ের গোড়ায় থাকে একটা চুক্তি। ক্রেতা আর বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি— নির্দিষ্ট দামে নির্দিষ্ট পণ্য বিনিময়ের চুক্তি। প্রশ্ন এই চুক্তির নৈতিকতা নিয়ে। কোনও চুক্তিকে নৈতিক হতে গেলে দুটো শর্ত পূরণ করতেই হয়। এক, চুক্তিটি স্বাধিকারের ভিত্তিতে তৈরি হতে হবে। অর্থাৎ, ক্রেতা বা বিক্রেতা, উভয় পক্ষকেই এই চুক্তিতে স্বেচ্ছায় সম্মত হতে হবে, কারও ওপর জোরজুলুম করলে চলবে না। দ্বিতীয় শর্ত হল, বিনিময়ের প্রতিদান যেন ‘অনুরূপ’ হয়। অর্থাৎ, শিল্প তৈরির জন্য একরপিছু এক লক্ষ টাকা দামে তেফসলা জমি বিক্রির চুক্তি তৈরি করলেও সেটা নৈতিক নয়, কারণ যিনি কিনছেন, তাঁর লাভ অনেক বেশি। এই বিনিময়ের প্রতিদান অনুরূপ নয়। দেখা প্রয়োজন, গর্ভ ভাড়ার চুক্তি এই দুটি শর্ত পূরণ করে কি না।

ভারতের মতো দেশে, কত জন মেয়ে স্বেচ্ছায় গর্ভ ভাড়া দিতে চায়, আর কত জনকে জোর করে বাধ্য করা হয়, সেই প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তবে, অন্তত তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়াই যায়, এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, সরকারি নজরদারি বাড়িয়ে, এবং বিভিন্ন অসরকারি সংস্থার চেষ্টায় হয়তো এমন অবস্থায় পৌঁছনো সম্ভব, যেখানে প্রতিটি সারোগেসির সিদ্ধান্তই মেয়েটির নিজস্ব, কোনও চাপের মুখে নেওয়া নয়। তাতে চুক্তির নৈতিকতার প্রথম শর্তটি পূরণ হবে।

কিন্তু, দ্বিতীয় শর্ত?

অসম বিনিময়

প্রায় ত্রিশ বছর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, একটা মামলা নিয়ে বিপুল হইচই হয়েছিল— ‘বেবি এম কেস’। নিউ ইয়র্কের এক সন্তানহীন দম্পতি, উইলিয়াম ও এলিজাবেথ স্টার্ন, মারি বেথ হোয়াইটহেড নামে এক মহিলার গর্ভ ভাড়া নেন, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের জন্য। ভাড়া স্থির হয় দশ হাজার ডলার। সন্তানের জন্মের পরই বেঁকে বসেন মারি বেথ। বলেন, তিনি মেয়েটিকে কিছুতেই স্টার্ন দম্পতির হাতে তুলে দেবেন না। স্টার্নরাও চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে মারি বেথ-এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলা গড়ায় নিউ জার্সি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। আদালত রায় দেয়, মেয়ের অধিকার গর্ভধারিণীরই। তাঁর আর স্টার্ন দম্পতির মধ্যে যে চুক্তি রচিত হয়েছিল, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।

আদালত বলেছিল, চুক্তিটি দাঁড়িয়ে আছে ‘অসম তথ্য’-এর ওপর। স্টার্ন দম্পতি জানতেন, তাঁদের কাছে দশ হাজার ডলারের মূল্য ঠিক কতখানি, এবং সেই পরিমাণ টাকা মারি বেথকে দিতে তাঁদের কতটা খারাপ লাগবে। কিন্তু, চুক্তিটি করার সময় মারি বেথ জানতেন না, আগামী ন’মাস তিনি গর্ভে যাকে ধারণ করবেন, তার প্রতি ঠিক কতখানি ভালবাসা তৈরি হবে তাঁর। সেই সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিতে তাঁর কতটা খারাপ লাগবে। আগে দুটি সন্তান থাকলেও তাঁর পক্ষে তৃতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে এই অনুভূতির কথা আগে জানা সম্ভব নয়। অনুভূতিটি গর্ভধারণের ন’মাসে তৈরি হয়।

যখন মারি বেথ তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের প্রতি তাঁর অনুভূতির কথা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারবেন এবং সেই সন্তানকে স্টার্ন দম্পতির হাতে তুলে দিতে তাঁর কতটা কষ্ট হবে তা বুঝতে পারবেন, চুক্তি মানলে তখন আর তাঁর কিছু করার নেই।কাজেই, গর্ভধারণের আগে হওয়া চুক্তি ন্যায্যতার প্রথম শর্তটি যদিও বা পূরণ করে, দ্বিতীয় শর্তটি পূরণে ব্যর্থ। সারোগেসির বিরুদ্ধে যদি যুক্তি সাজাতেই হয়, তবে এখান থেকেই শুরু করতে হবে।
বাজারের মাপকাঠি

কিন্তু, এই যুক্তিরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে বিলক্ষণ। যাঁরা বাজারপন্থী, তাঁরা বলবেন, শুধু গর্ভ ভাড়া দেওয়া কেন, কোনও চুক্তির ক্ষেত্রেই কি একেবারে গোড়ায় সেই চুক্তির পুরো মর্ম বা সমস্ত সম্ভাব্য পরিণাম বোঝা সম্ভব হয়? এই যুক্তি ব্যবহার করলে তো বিনিময় ব্যাপারটাকেই তুলে দিতে হয়।

আপত্তিটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কাজেই, গর্ভ ভাড়া দেওয়ার ‘বাজার’-এর নৈতিকতা যাচাই করতে আরও কিছু মাপকাঠি চাই। তেমনই একটি হল, এই বিনিময়ের চুক্তি বৃহত্তর সমাজে কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে কি না, দেখা। যেমন, কেউ স্বেচ্ছায় ক্রীতদাস হতে চাইলেও তাকে সে অধিকার দেওয়া যায় না এই নেতিবাচক প্রভাবের কারণেই। সেই বিনিময় সমাজের মূল্যবোধের ওপর এমন প্রভাব ফেলবে, মানবিক সম্পর্কগুলিকে এমন ভাবে বিকৃত করবে যে তার ক্ষতি ওই বিনিময় থেকে পাওয়া লাভের তুলনায় ঢের বেশি। মাদক কেনাবেচার বাজারকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার কথা উঠলেও এই মাপকাঠিই কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াবে।  গর্ভ ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও কি তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা আছে? ভেবে দেখা ভাল।

অন্য একটি মাপকাঠি হল দীর্ঘমেয়াদের পরিণতির কথা বিচার করে দেখা। কোনও বিনিময়ের ফলে যদি এক পক্ষের কোনও দীর্ঘমেয়াদি এবং অপূরণীয় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে, তবে সেই বিনিময়কে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না। কিডনি বা অন্যান্য জরুরি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচার উপরে যে কারণে দুনিয়া জুড়ে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। গর্ভ ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও কি তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে? যেমন, গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত গর্ভধারণ সম্ভবত সার্ভিকাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

অতিরিক্ত গর্ভধারণের ঝুঁকি নিয়ে যেহেতু গবেষণা এখনও চলছে, তাই গর্ভ ভাড়া দেওয়ার অধিকার স্বীকার করে নেওয়া উচিত কি না, এখনই এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করলে আরও একটি বাড়তি মাত্রা যোগ হয়। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মাত্রা। গর্ভ ভাড়া দেওয়া সত্যিই দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকারক কি না, হলে ক্ষতির মাত্রা কতখানি, এই প্রশ্নের উত্তর এখনও সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। কাজেই, এই মাপকাঠির ভিত্তিতে বিনিময়টি চলতে দেওয়া যায় কি না, তারও কোনও স্পষ্ট উত্তর থাকা সম্ভব নয়।

এমন মাপকাঠি আরও আছে। সেগুলিকে ঘিরে বিস্তর প্রশ্নও আছে। তবে, সঙ্ঘের পাঠশালার পড়ুয়াদের কাছে এই দার্শনিক তর্ক প্রত্যাশা করা অর্থহীন। নরেন্দ্র মোদীরা এই আলোচনায় ঢুকবেনই না। বরং, এহেন জরুরি একটি প্রসঙ্গকেও সস্তা জাতীয়তাবাদের মোড়কে বেচে দিতে চেষ্টা করবেন। যার দৌড় যতখানি।