গভর্নরের শেল্টারে লুটপাট-মাসোহারা দিত এস-আলম
বিশেষ প্রতিনিধি : বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড় দেওয়ার কারণেই ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাট হয়েছে। এস আলমের মত লুটেরা গডফাদারদের বাংলাদেশ ব্যাংক (বি-বি) এর সহযোগীতার কারণে পুরো ব্যাংকিং খাত বিপদগ্রস্থ হয়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন।তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক’ ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখান থেকে একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে বের করে নেওয়ার পরই ব্যাংক খাত বিপদ পড়তে শুরু করে।
ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন আরো বলেন, ক্ষমতার পালাবদলের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার বিকালে ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংক এবং ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নাম না নিয়ে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) চেয়ারম্যান।
ব্র্যাক ব্যাংকের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দেশের স্বনামধন্য একটি বড় ব্যাংক জোরপূর্বক দখলে নেয় একটি গ্রুপ। তারপর সেই ব্যাংকে নিজেদের লোকজন বসায় বোর্ডে। তারপর সেই ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ধীরে ধীরে সেই ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে।“…গত দশ বছরে ব্যাংক খাতকে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চালানো হয়েছে। জোরপূর্বক ব্যাংক দখল করে নিজেদের মত লোকজন বসিয়েছেন। আইন ভঙ্গ করে বোর্ডে নিজেদের লোকজন বসিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড় দেওয়ার কারণেই এসব ঘটনা ঘটেছে। পুরো ব্যাংকিং খাতকে বিপদে ফেলেছে।
ইসলামী ব্যাংকের নাম উল্লেখ না করলেও ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া এ ব্যাংককেই সেলিম আর এফ হোসেন ইঙ্গিত করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।ছাত্র-জনতার প্রবল গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই ইসলামী ব্যাংক ও এস আলম নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।গত কয়েক বছরে ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে এস আলম গ্রুপ ৭৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ হিসেবে নিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকেই ৬৭ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার তথ্য এসেছে।
এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ৫২ শতাংশের মত, যা এখন ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে।গত ৫ অগাস্ট সরকার পতন হলে এস আলম গ্রুপের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের ইসলামী ব্যাংক থেকে বের করে দেন বিক্ষুব্ধ ব্যাংকাররা।কোনো কোনো গ্রুপকে বিশেষ সহায়তা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে দায়ী করছেন আর এফ হোসেন।এসব কর্মকর্তারা বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আপস করতেন বলে তার অভিযোগ।
আর এফ হোসেনের ভাষ্য, নয়-ছয় নীতিটি বড় রকমের সমস্যা তৈরি করেছে। কারণ এতদিন সংসদ সদস্য ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ী ছিলেন। তারা তাদের নিজেদের সুবিধা মত তখন নীতি প্রণোয়ন ও আইন প্রয়োগ করতেন।আর ব্যবসায়ীরা কম খরচে ব্যাংক থেকে টাকা বের করত। আমানতকারীদের সুদহার বাড়ানো সম্ভব হত না। ২০১৯ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আসার পর নানারকম নীতি প্রণয়ন করেছেন। সেসময় থেকেই ইচ্ছামত ঋণ নিত, কারণ ঋণ ফেরত না দেওয়ার জন্য।
ব্যাংকিংখাতকে দুর্বল ও ডলার বাজারকে অস্থিতিশীল করার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়ী করে এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, “সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই এবং বর্তমানে কর্মরতরা ডলার বাজারকে অস্থিতিশীল করার পেছনে দায়ী। এ দর নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন কোন কর্মকর্তা দায়ী, সেটা নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রয়োজন পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আমরা তথ্য দিব, কারা এর পেছনে দায়ী।
আড়াই বছরে ডলারের দর বার বার পরিবর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই ডলার বাজারকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল, যা কার্যকর হয়নি। উল্টো ডলার বাজার খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার দর নিজেই অস্থির করেছে, পরে তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এমডি ও ট্রেজারি প্রধানদের জরিমানা করত। তখন আনুষ্ঠানিকভাবে এক দর ঘোষণা করত বাংলাদেশ ব্যাংক, আর ব্যাংকগুলোকে আলাদা আলাদা দর নির্ধারণ করে দিত।
কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড এখন আর হবে না।তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে, সেখানে খেলাপি হয়নি। সেটা দেশের জন্য একটি ভালো সংকেত। আগামীতেও সরকার খেলাপি হবে না, তাই সেটার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের ওপর আস্থা প্রকাশ করে তার সঙ্গে সোমবার অনুষ্ঠিত ১২ টি ব্যাংকের এমডিদের সভার প্রসঙ্গও তোলেন তিনি। আর এফ হোসেন বলেন, গভর্নর জানিয়েছেন বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা ভালো। ২০ বিলিয়নের ওপরে থাকলেই তা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড। গভর্নরের সঙ্গে সভায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স বাড়ানো, সময়মত রপ্তানি আয় দেশে নিয়ে আসা, ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ডলার বাজারকে স্থিতিশীল করা, আন্তঃব্যাংক লেনদেন চালু, ডলার দর ও ব্যাংকের ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করাসহ সামগ্রিক ব্যাংকিংখাত নিয়ে আলোচনা করা হয়।
অগাস্ট মাস থেকেই দেশে রেমিটেন্স বাড়ার প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, গভর্নর জানিয়েছেন, ডলার দর ও ব্যাংক ঋণ সুদহারে কোনো রকমের হস্তক্ষেপ করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর পরামর্শ দিয়েছেন আন্তঃব্যাংক বাজারকে সচল করার জন্য। আনুষ্ঠানিক দরে ডলার কেনাবেচা করার জন্য। সময়মত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। কারণ এ বিষয়ে স্বচ্ছতা থাকতে হবে।
গভর্নর বলেছেন, যদি ডলার দর অনেক বেশি বেড়ে যায়, তাইলে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে আনবে, অর্থাৎ অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে দিবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। তাই সংকোচনশীল মুদ্রানীতির দিকেই থাকা হবে। রেপো রেট ও ট্রেজারি বিলের সুদহারের ফারাক রয়েছে। এ বিষয়টি সমন্বয় করা হবে।
৩০০ বেসিস পয়েন্টের মত ফারাক আছে। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের মধ্যেই রয়েছে। তাই রিজার্ভ নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।তিনি বলেন, ছয়/সাতটা ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ সুবিধা দিয়ে পরিচালনা করতে দিয়ে বাকি ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা আইন করত। এসব কর্মকাণ্ড ব্যাংকখাতে আর হবে না বলে গভর্নর আশ্বস্ত করেছেন।