সাব রেজিস্ট্রারের ১২টা বাজলো..
স্টাফ রিপোর্টার : সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তির জবাব দিতে গণশুনানিতে এসে ‘ঘুষ’ দাবির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে আটকা পড়লেন ঢাকা সদরের সাব রেজিস্ট্রার আব্দুল কুদ্দুস হাওলাদার।বুধবার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটউশনে দুদকের গণশুনানিতে একজন অভিযোগ করেন, কুদ্দুস হাওলাদার নিজ কার্যালয়ে ‘দালাল’ রেখেছেন এবং তার মাধ্যমে ‘ঘুষ’ নিয়ে থাকেন।
ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা গাজী শহিদুল্লাহ পায়েল বলেন, “২০১০ সালের একটি দলিলের কপি উঠাতে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গেলে শহীদ, রাসেল, সাজ্জাদকে দেখতে পাই। দলিল উঠাতে হলে ১২/১৩ হাজার টাকা লাগবে বলে জানায় রাসেল। এরপর সাব রেজিস্ট্রার কুদ্দুস হাওলাদারকে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, ‘রাসেল যা বলেছে, সেই অনুযায়ী হবে’।”
অভিযোগটি শুনে জবাব দিতে সাব রেজিস্ট্রার কুদ্দুসকে অনুরোধ করেন দুদকের ঢাকা বিভাগের পরিচালক ও গণশুনানির সঞ্চালক নাসিম আনোয়ার।জবাবে কুদ্দুস বলেন, “উনি (অভিযোগকারী) কখন গিয়েছিলেন, তা এখন আমার মনে নেই। তবে রাসেল অফিসের কোনো স্টাফ না, সে চা-পানি খাওয়ানোর কাজ করে থাকে।”
এ সময় কুদ্দুসের উদ্দেশে নাসিম প্রশ্ন করেন, “রাসেল, সাজ্জাদরা কী করে টাকা চায়? এদেরকে ডেকে এনে কেন এই দায়িত্ব দিলেন?” এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সাব রেজিস্ট্রার কুদ্দুস হাওলাদার।তখন দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বিষয়টি এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত করে মহানিবন্ধক (আইজিআর) সাহেব ব্যবস্থা নেবেন বলে আমি অনুরোধ করছি।”
এছাড়া সাব রেজিস্ট্রার কুদ্দুস হাওলাদারের সম্পদের বিষয়ে সরাসরি দুদক অনুসন্ধান করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে নাসিরউদ্দিন জানান।বাংলাদেশের ভূমি অফিসগুলোতে দুর্নীতির অভিযোগ বহুদিনের। জমির দলিল তোলাসহ সেখানে প্রতিটি কাজে ঘুষ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
গণশুনানিতে সাভারের কামরুজ্জামান অভিযোগ করেন, সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মী নয়, এমন অনেকে সেখানে থাকেন, তাদের মাধ্যমেই ঘুষের টাকা লেনদেন হয় । নিয়ম না থাকলেও প্রতি দলিলে সেরেস্তা ফি বাবদ ৭০০ টাকা নেওয়া হয়। বিশেষ কৌশলে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে নাসিম আনোয়ার বলেন, “রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে কি না, সেই বিষয়ে আমরা অনুসন্ধান করব। কেইস স্টাডি হিসেবে সাভার সাব রেজিস্ট্রি অফিস অনুসন্ধান করা হবে।”এছাড়া সাব রেজিস্ট্রি অফিসে কর্মী বাদে যারা থাকেন, তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য ঢাকা জেলা সাব রেজিস্ট্রারকে অনুরোধ জানান দুদক কর্মকর্তা।
তবে যারা ঘুষের টাকা ‘হ্যান্ডলিং’ করেন, তাদের বিশেষ কৌশলে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন নাসিম আনোয়ার।এরপর ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার বলেন, “স্টাফ রাখার অভিযোগটি আমরা বিভাগীয় তদন্ত করব, তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
শাহজাহানপুর থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী পারভিন রশিদ অভিযোগ করেন, শাহজাহানপুরের শহীদবাগে তার শ্বশুরের মালিকানাধীন একটি জমি বিক্রি না হলেও পাশের আরেটি জমি তাদের চৌহদ্দি দেখিয়ে বিক্রি হয়েছে। যে কারণে তারা জমিটি হারিয়েছেন। জমিটির অবৈধ বিক্রির দলিল তৈরিতে সাব রেজিস্ট্রার সহায়তা করেছেন।এ বিষয়ে গুলশানের সাব রেজিস্ট্রার মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, “এটা রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত বিষয় না। চৌহদ্দির বিষয়ে সাব রেজিস্ট্রারের হাত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
আর জেলা রেজিস্ট্রার দীপক বলেন, “বিষয়টা হচ্ছে এই জমিটি দখল হয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। এছাড়া উচ্ছেদের জন্য তিনি মামলাও করতে পারেন।”বিষয়টি জেলা প্রশাসককে দেখার জন্য দুদকের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হবে বলে দুদকের কমিশনার নাসির উদ্দিন আহমেদ জানান।
দোহরের আবুল কাসেমের অভিযোগ, দলিল করতে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সেরেস্তা ফি নামে টাকা নেওয়া হচ্ছে।
দলিল লেখকরা একটি দলিলের জন্য কত টাকা নিতে পারেন সেই বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন তিনি।এ বিষয়ে গুলশানের সাব রেজিস্টার বলেন, “সেরেস্তা ফি নামে কোনো ফি নেই, এখন পে-অর্ডারের বাইরে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।”
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার বলেন, “২০১৪ সালে দলিল লেখকদের ফি সংক্রান্ত নীতিমালা হয়েছিল, কিন্তু তা অমীমাংসিত। এ জটিলতার কারণে সেখানে হয়রানির হচ্ছে। এই বিষয়টি মাননীয় আইজিআরকে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আমরা অনুরোধ জানাব।”আশুলিয়া থেকে আসা রহিম উদ্দিন বলেন, “স্থানীয় সাব রেজিস্ট্রি অফিসে দালালে ভরা। সারাদেশেই একই অবস্থা বিদ্যমান।”
এ বিষয়ে দুদক পরিচালক নাসিম আনোয়ার বলেন, “বিষয়গুলো আমরা অনুসন্ধানে দেওয়া চেষ্টা করছি। কেউ যদি ঘুষ চায় আপনারা দেবেন না। আপনারা ১০৬ নাম্বারে ফোন করে দুদকে অভিযোগ জানাবেন। ঘুষ দেব না- এমন সংস্কৃতি চালু করেন।”কেরানীগঞ্জের বেগম বেদৌরা আলী বলেন, “জমি রেজিস্ট্রারের শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। সেটা অহরহ হচ্ছে, এর কারণে সরকার ব্যাপক রাজস্ব হারাচ্ছে।”
রেজিস্ট্রেশনের জন্য অন্যায়ভাবে হাজার হাজার টাকা নেওয়া হয়ে থাকে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।এই বিষয়ে নাসিম আনোয়ার বলেন, শ্রেণি পরিবর্তন করে দলিল করার অভিযোগে গাজীপুরের এক সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে।
এই ধরনের আরও ঘটনা থাকলে দুদকে অভিযোগ জানাতে তিনি অনুরোধ করেন।নাসিম বলেন, “সাব রেজিস্ট্রি অফিসে পাসপোর্ট অফিসের মতো দালাল চক্র আছে। কমিশন থেকে এসব অভিযোগের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যানের নজরে আনেন।”
অনুষ্ঠানের শুরুতে আইজিআর খান মো. আব্দুল মান্নান বলেন, “আমরা যারা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’, যারা বড় অফিসার হয়ে যাই, তারা অতি অহংকারে নিজেদের রাষ্ট্রের মালিক যে জনগণ, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। আমাদের সামনে সেবা নিতে আসা মানুষগুলোকে আমাদের ভাই বা পিতা ভাবতে পারি না।”
তিনি বলেন, “এটাও সত্য সাব রেজিস্ট্রার অফিস সম্পর্কে যে নেতিবাচক কথা শোনা যায়, তার পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণও আছে। আমাদের সামনে কিছু ব্যারিয়ার আছে। এর সবচেয়ে বড় ব্যারিয়ার হলো দলিল লেখকরা। সেখানে গিয়েই জনগণ প্রাথমিকভাবে ভোগান্তিতে পড়েন এবং অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েন।”দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, “সরকার বা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি করা কাজ আমাদের নয়। তবে তাই বলে অন্যায় করে কেউ পার পাবে না।”
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করার অভিযোগ অনুসন্ধানে সাভার সাব রেজিস্ট্রি অফিসকে ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে নেওয়ার কথা জানান তিনি।তিনি বলেন, “গত এক বছর এই অফিসে যত দলিল হয়েছে, তা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সরকারের কত টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, তা খুজেঁ বের করবে দুদক।”