ক্যান্সার থেকে বাঁচতে হলে-
আসমা খন্দকার : ট্যানারির বর্জ দিয়ে তৈরী করা হাঁস মুরগি মাছের খাবারে ক্যান্সারের উপাদান রয়েছে। ফলে ট্যানারির বর্জে পালিত হাঁসমুরগি ও মাছ খেলে মানুষের শরীরে ক্যান্সার হতে পারে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, ট্যানারির বর্জ্য থেকে উত্পাদিত পোলট্রি ফিডে হেভিমেটালে ক্যাডমিয়াম, লেড (সিসা), মার্কারি (পারদ) ও ক্রোমিয়ামসহ বেশ কিছু বিষাক্ত পদার্থ মিলেছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, দেশে উৎপাদিত হাঁস, মুরগি ও মাছের শরীরে মিলেছে হেভিমেটাল (এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ)। যা হাঁস, মুরগি ও মাছের শরীরে প্রবেশ করছে খাদ্যের মাধ্যমে। বিভিন্ন ধাতু ও রাসায়নিকসমৃদ্ধ বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য খাবার হিসেবে অধিক মুনাফার জন্য ব্যবহার করছে খামারিরা। এ ধরণের মাছ ও মাংস গ্রহণ করলে তা মানবশরীরে প্রবেশ করে। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্রোমিয়ামসহ এসব ধাতু ও রাসায়নিক থেকে ক্যান্সার, হূদরোগ, আলসার, কিডনির অসুখ হতে পারে। মানবদেহে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম প্রবেশ করলে পুরুষের সন্তান উত্পাদনক্ষমতা হ্রাস, নারীদের অকাল প্রসব, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগও হয়ে থাকে। দেশে ক্যান্সার রোগী বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বিষাক্ত মাছ ও মাংস গ্রহণ।
জানা গেছে, প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হাঁস, মুরগি ও মাছ খেয়ে মানুষ মূলত গ্রহণ করছে ক্ষতিকর রাসায়নিক, যা মানুষকে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ খাবার গ্রহণ করে। কিন্তু এই খাবারই যে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে তা কয়জন জানে। শহরে ফাস্টফুড ও বাসা-বাড়িতে ফার্মের মুরগির চাহিদা খুব বেশি। কিন্তু মুরগির মাংসের নাম করে আমরা আসলে কী খাচ্ছি? কখনো কি জানতে চেয়েছি? জানার চেষ্টা করেছি? বা জেনে খাচ্ছি?
শ্রীলংকায় ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে তৈরি বিষাক্ত হেভিমেটাল যুক্ত খাবার নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে শ্রীলংকায় হেভিমেটালযুক্ত খাবার ব্যবহার করা হতো। এক পর্যায়ে শ্রীলংকার একটি গ্রামে যখন বহু মানুষের কিডনি সমস্যা দেখা দেয়, তখন আলোচনা উঠে বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ওই গ্রামে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, হেভিমেটালযুক্ত খাদ্য খাওয়া হাঁস, মুরগি ও মাছের মাধ্যমে এটি হয়েছে। বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে তৈরি সার কৃষি জমিতে ব্যবহারের ফলেও কিডনি রোগ হয়। পরে শ্রীলংকা এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। কেউ করলে মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশে আগে হাঁস-মুরগি-মাছ বড় হতো প্রাকৃতিকভাবে। ভাত, ধানের কুঁড়া ও ভুসি খাওয়ানো হতো। আর ফার্মের মুরগি বা মাছের খাবার হলো দানাদার। যার সঙ্গে মিশ্রিত থাকে নানা রকম রাসায়নিক। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হেভিমেটাল। যার কারণে এসব খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি বড় হয় ফার্মের মুরগি, ওজনও বাড়ে। এসব খাবারে লুকিয়ে আছে মরণঘাতী ব্যাকটেরিয়াসহ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক জীবাণু।
যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সহজ নয়। বাজারে বিক্রি হওয়া হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য (পোলট্রি-ফিশ ফিড) খাওয়ানো মুরগি কেটে এর রক্ত, মাংস, হাড়, কলিজা, মগজ ও চামড়া আলাদাভাবে পরীক্ষা করে আঁঁতকে উঠেছেন গবেষকরা। প্রথম দফায় এক মাস এসব খাদ্য খাওয়ানোর পরে এবং দ্বিতীয় দফায় আরেক মাস খাদ্য খাওয়ানোর পরে পরীক্ষা করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। এসব মুরগির মাথার মগজে সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্রোমিয়াম পাওয়া যায়।
ক্রোমিয়াম হলো এক ধরনের ভারী ধাতু, মানবদেহে যার সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা হলো প্রতিদিন ২৫ পিপিএম বা মাইক্রোগ্রাম। এর বেশি হলে অতিরিক্ত অংশ শরীরে জমা হতে থাকবে এবং একপর্যায়ে প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু পরীক্ষায় এক মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে পাওয়া যায় ৭৯৯ পিপিএম এবং দুই মাস খাদ্য খাওয়া মুরগির মগজে (প্রতি কেজিতে) পাওয়া যায় চার হাজার ৫৬১ পিপিএম। এছাড়া মাংসে যথাক্রমে ২৪৪ ও ৩৪৪, চামড়ায় ৫৫৭ ও ৩২৮, হাড়ে এক হাজার ১১ ও এক হাজার ৯৯০, কলিজা বা লিভারে ৫৭০ ও ৬১১ এবং রক্তে ৭১৮ ও ৭৯২ পিপিএম ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই মাত্রা মানবদেহের জন্য অসহনীয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন বিপজ্জনক মাত্রার হেভিমেটালযুক্ত মাছ বা মুরগির মাংস কিংবা ডিম খেয়ে দেশের মানুষ এমন পর্যায়ে রয়েছে, যাকে বলা যায় ‘বিষাক্ত পুষ্টি’। জানা গেছে, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ট্যানারি বর্জ্য থেকে পোলট্রি ও মাছের খাদ্য তৈরি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু উচ্চ আদালতের এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই দেদারসে ট্যানারি বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে মাছ ও পোলট্রি ফিড।
বিষয়টি অবহিত হয়ে সাভারের ভাকুপতা ইউনিয়নে বিষাক্ত ট্যানারি দিয়ে তৈরি হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য উত্পাদনকারী ৫টি কারখানায় র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ১১ হাজার টন বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য দিয়ে তৈরি হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য জব্দ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর ও র্যাব-৪ এর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিষাক্ত হেভিমেটাল উত্পাদনকারী দুই মালিককে এক বছরের জেল ও ৬ জন কর্মচারীকে জরিমানা করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কজেল হাসপাতালের কিডনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেন, হেভিমেটাল স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। আমরা যে খাবার গ্রহণ করি তা কিডনি দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু হেভিমেটাল কিডনিতে আটকে যায়। লিভার নষ্ট করে, শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ক্ষতি করে। তিনি বলেন, দেশে কিডনি রোগ আশঙ্কাজনভাবে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই হেভিমেটাল।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এএমএম শরিফুল আলম বলেন, হেভিমেটালের কারণে দেশে ক্যান্সার রোগী বাড়ছে। যে কোন কেমিক্যাল ব্যবহৃত খাবার খেলেই ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটা গবেষণায় প্রমাণিত। এছাড়া হরমোনজনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়। গর্ভবতী অবস্থায় শরীরে হেভিমেটাল গেলে মা-শিশু দুই জনেরই ক্যান্সার ও কিডনি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
জাতীয় নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, হেভিমেটাল গ্রহণের ফলে মস্তিস্কের স্নায়ু অকেজো হয়ে যায়। এটার নাম নিউরোপ্যাথি। হাত-পা অবশ হয়ে যায়। চলাফেরা করা যায় না। এটাকে নিউরো প্যাথি বলে। সম্প্রতি এটা ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। এ রোগ ওষুধেও ভাল হয় না।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, হাবাগোবা শিশুর জন্ম ও অল্প বষয়ে ডায়াবেটিস হওয়ার অন্যতম কারণ এই হেভিমেটাল। ফাস্টফুড একবারে পরিহার করার পরামর্শ দেন তারা। জানা যায়, আগে ট্যানারির বর্জ্য সাধারণত বিভিন্নভাবে অপসারণ করা হতো। বেশির ভাগই ফেলা হতো বুড়িগঙ্গা নদীতে। কয়েক বছর আগে এই বর্জ্য দিয়ে খামারের মাছ ও মুরগির খাদ্যের অন্যতম উপাদান শুঁটকি তৈরির ব্যবসা শুরু হয়। লাভ বেশি হওয়ায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠে একের পর এক কারখানা। এ শুঁটকি খেয়ে বেড়ে ওঠা হাঁস, মাছ ও পোলট্রির মাংসও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এ কারখানাগুলো শুধু মানবস্বাস্থ্যের জন্যই ঝুঁকি বহন করছে না, পরিবেশেরও মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনছে।