ক্যান্সারে আক্রান্ত এক-এগারো’ সেই নায়ক
বিশেষ প্রতিনিধি বিবিসি অবলম্বনে : আমেরিকার জ্যামাইকায় বসবাসকারী সেই জেনারেল মইন ইউ আহমেদ এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত। এক-এগারো’ কি ঘটেছিল? সেই নায়কে’র অজানা অধ্যায় থেকে তুলে আনা হয়েছে।
২০০৭ সালের এগারোই জানুয়ারি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিরাট পট পরিবর্তন হয়েছিল তা সবারই জানা। আজ দশ বছর পূর্ণ হলো সেই দিনটির।
সেদিন বিকেলে বঙ্গভবনের ভেতরে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা প্রয়াত প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সাথে কী হয়েছিল, তা বিভিন্ন জনের বয়ানে খণ্ড খণ্ড ভাবে এসেছে বিভিন্ন সময়ে।
কিছু চিত্র পাওয়া যায়, সেদিনকার ঘটনাপ্রবাহের প্রধান কুশীলব সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের লেখা একটি বই থেকে।
২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘শান্তির স্বপ্নে’ নামক স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থে সেসময়কার জেনারেল আহমেদ লিখেছেন, তিনি-সহ সশস্ত্র বাহিনীর অন্যান্য প্রধান ও ডিজিএফআইয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্তা সেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন।
তারা আড়াইটার সময় বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। ভেতরে গিয়ে শোনেন, প্রেসিডেন্ট মধ্যাহ্নভোজ করছেন। তাদের একটি কামরায় অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা করবার পর প্রেসিডেন্টের দেখা মেলে। প্রেসিডেন্টকে তারা ‘মহা-সংকটময় পরিস্থিতি’ থেকে দেশকে উদ্ধার করার অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট বিষয়টি ভেবে দেখার সময় নেন।
জেনারেল আহমেদ তার বইতে লিখেছেন, “আমি জানতাম ইতোপূর্বে উপদেষ্টা পরিষদের অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত অজানা কোন কারণে ও প্রভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে। যার কারণে আমরা কোনো দুষ্টচক্রকে আবার নতুন কোনো খেলা শুরু করার সুযোগ দিতে চাচ্ছিলাম না। কক্ষে নেমে এলো সুনসান নীরবতা …… আমার মনে হলো আমাদের চোখ দিয়ে পুরো দেশ যেন তাকিয়ে আছে প্রেসিডেন্টের দিকে”।
দীর্ঘ নীরবতার পর প্রেসিডেন্ট জরুরী অবস্থা জারীর পক্ষে মত দেন।
সেই সাথে তিনি নিজে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেবেন বলে জানান।
বইতে ছ’টার সময় বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসার কথা লিখেছেন জেনারেল আহমেদ, অর্থাৎ দু’ঘণ্টার মত তারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। ২০০৬ সালের ২৯শে অক্টোবর প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ নেন প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।
এই দু’ঘণ্টায় ঠিক কিভাবে তারা বুঝিয়েছিলেন প্রেসিডেন্টকে, কোন প্রেক্ষাপটে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জরুরী অবস্থা জারী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিতে রাজী হলেন, তার খুব স্পষ্ট একটা ধারণা জেনারেল আহমেদের এই লেখায় পাওয়া যায় না। তবে বঙ্গভবনে যাওয়ার প্রেক্ষাপট কেন তৈরি হল, তা তিনি তার বইতে সবিস্তার লিখেছেন।
মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি:
ওইদিন বঙ্গভবন থেকে আর জীবিত ফিরে নাও আসতে পারেন বলে ধারণা করেছিলেন জেনারেল আহমেদ। মইন ইউ আহমেদ লিখেছেন, তিনি এমন কিছু প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছিলেন, যার কারণে তৎক্ষণাৎ রাষ্ট্রপতি তাদের বরখাস্ত করতে পারেন, গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারেন, এমনকি হত্যার নির্দেশও দিতে পারেন।
বঙ্গভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্ভেদ্য উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “…তারা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হলেও তাদের কর্মপদ্ধতি ভিন্ন। বঙ্গভবনে তাদের কাছে প্রেসিডেন্টই একমাত্র ভিভিআইপি যাকে রক্ষা করতে তারা নিয়োজিত”।
“এমনকি প্রেসিডেন্টের জীবনের উপর হুমকি মনে করলে তারা যে কাউকে হত্যা করতে পারে। পিজিআর কিংবা এসএসএফ, সেনাবাহিনী কিংবা অন্য কোনো বাহিনীর চেইন অব কমান্ডের আওতাধীন নয়। এমন নিরাপত্তা বলয়ে আমরা কজন যাচ্ছি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায়”।
আমি জানতাম হতে পারে এ যাত্রাই সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আমার শেষ যাত্রা কিংবা কে জানে হয়তো জীবনের শেষ যাত্রা।বঙ্গভবনে রওয়ানা হওয়ার আগে মেজর জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়াকে তিনি বলেছিলেন, “আমি না ফিরলে পরবর্তী পরিস্থিতি সিজিএস হিসেবে প্রাথমিকভাবে তাকেই সামাল দিতে হবে”।
জেনারেল মইন ইউ আহমেদকে এক-এগারোর প্রধান কুশীলব বলে মনে করা হয়। তার বই ‘শান্তির স্বপ্নে”তে তিনি নিজেও সেরকমটিই ইঙ্গিত দিয়েছেন। রাজনীতিতে কোনোভাবেই সেনাবাহিনীকে জড়াতে চাননি, একথা বারবার ‘শান্তির স্বপ্নে’ বইতে লিখেছেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ।
এমনকি তিনি যখন ডিভিশন কমান্ডারদেরকে দেশের অবস্থা বর্ণনা করতেন এবং তাদের মতামত শুনতে চাইতেন তখন তারাও দ্রুত কিছু করার তাগিদ দিতেন।এক্ষেত্রে সাভারের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর কথা বইতে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন জেনারেল আহমেদ।আমি তাদের বুঝাতাম রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই।
তাহলে কেন জড়ালেন?
এক-এগারো পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সেনাবাহিনী সরাসরি না থাকলেও সবখানেই যে তাদের প্রচ্ছন্ন হস্তক্ষেপ ছিল একথা সর্বজনবিদিত, যে কারণে দেশে-বিদেশে ওই সরকার ‘সেনা সমর্থিত সরকার’ বলেই পরিচিত।
জেনারেল আহমেদ বলছেন, জাতিসংঘের একটি প্রচ্ছন্ন হুমকির কথা, যেখানে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল।
তিনি লিখছেন, “সেনাবাহিনীর সীমিত আয়ের চাকরিতে সৈনিকদের একমাত্র অবলম্বন জাতিসংঘ মিশন। তাদের সামনে থেকে যদি সেই সুযোগ কেড়ে নেয়া হয় তাহলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়বে”।
প্রধান উপদেষ্টার সন্ধানে:
বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের মূল কাজ হয় প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজী এমন একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি খুঁজে বের করা।
জেনারেল আহমেদ লিখেছেন, বঙ্গভবনেই প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন তাদের দুটো নাম প্রস্তাব করেছিলেন, একজন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস, অপরজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদ। প্রফেসর ইউনুসকে প্রথম ফোনটি করেন জেনারেল আহমেদ। প্রফেসর ইউনুস অস্বীকৃতি জানান।
“তিনি বললেন, বাংলাদেশকে তিনি যেমন দেখতে চান সেরকম বাংলাদেশ গড়তে খণ্ডকালীন সময় যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে আরো দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দিতে আগ্রহী। সেই মুহূর্তে ড. ইউনুসের কথার মর্মার্থ বুঝিনি……..পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি তিনি একটি রাজনৈতিক দল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন যদিও পরিস্থিতির কারণে তাকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিল”।
ড. ফখরুদ্দীন আহমেদকে ফোন করে ঘুম থেকে জাগানো হয় গভীর রাতে।প্রধান উপদেষ্টা হবার আমন্ত্রণ পেয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় চান তিনি। আধ ঘণ্টা পর ফিরতি ফোনে সম্মতি জানান।
ওই দিনটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাবহুল দিন নাইন-ইলেভেনের মত করে এক-এগারো হিসেবে অভিহিত করার সিদ্ধান্তও তারাই নিয়েছিলেন বলে বইতে লিখেছেন মইন ইউ আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়ার পর সেই যে বাংলাদেশ ছেড়েছেন ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ, আজও ফেরেননি।
সেনাবাহিনীর ওই দিনের এই উদ্যোগ সেসময়ে বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
যদিও সেনা সমর্থিত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরবর্তী দুবছরের কর্মকাণ্ড পরে বেশ বিতর্কই সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলা বলে পরিচিত প্রধান দুই দলের দুই নেত্রীকে অপসারণের একটি চেষ্টা নিয়ে আজো বাংলাদেশে সমালোচনা চলে।
এখন কে কোথায়?
২০০৮ সালের শেষাংশে ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পরবর্তীতে ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এরপর আর দেশে ফিরেছেন বলে শোনা যায়নি।
ওয়াশিংটনে তিনি থাকেন বলে বাংলাদেশের কোন কোন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, যদিও জনসমক্ষে তিনি আসেন না বলেই প্রকাশ।
জেনারেল মইন ইউ আহমেদও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হয়েছেন অবসর গ্রহণের পর। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বরাতে জানা যাচ্ছে, তিনি নিউইয়র্কের জ্যামাইকার বাসিন্দা। ক্যান্সারে ভুগছেন তিনি।
তিনিও জনসমক্ষে আসেন না। মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী নতুন রাজনৈতিক সরকারের অধীনে বিদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও পালন করেন।পরে তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং তিনি এখন দেশেই বসবাস করছেন।