কোটি কোটি ডলার ঢেলেও ফাঁসি বহাল মীর কাশেমের
শফিক রহমান : কোটি কোটি ডলার ঢেলেও শেষরক্ষা হলোনা। ফাঁসি বহাল মীর কাশেমের।অবশেষে আজ রিভিউ খারিজ হয়ে গেছে মহা-তদবিরবাজ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের। ফাঁসিতে ঝুলতেই হচ্ছে মীর কাসেমকে।ফাঁসির কাষ্ঠে যেতে হচ্ছে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে। মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে তার করা রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির বেঞ্চ আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টায় এ রায় ঘোষণা করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, টাকা থাকলেই যে আইন ও বিচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল ও রিভিউ খারিজের রায়ে তা নতুন করে প্রমাণিত হলো।
এটা আমাদের জন্য সার্থকতা; টাকা থাকলেই যে আইনের হাত থেকে বা বিচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, অন্তত মীর কাসেম আলীর বিচারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আইনের শাসন বা বিচার বিভাগের রায়টাই প্রধান।
এর আগে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর জামায়াতের কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়। এরপর ৮ মার্চ আপিল বিভাগের রায়েও একই সাজা বহাল থাকে।
কে এই মীর কাশেম
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস কাসেম আলী রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে অসাধারণ ধূর্ততার স্বাক্ষর রেখে অত্যন্ত দ্রুততায় নিজের ও দলের উন্নতি ঘটান, পরিণত হন জামায়াতের আর্থিক মেরুদণ্ডে।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর একে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্কিত করতে বিভিন্ন প্রয়াস দেখা যায়, যাতে জামায়াতের হয়ে মীর কাসেম অর্থ ঢেলেছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকেই অভিযোগ আসে।
২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার দিয়েছেন। লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই চুক্তির কপি এবং টাকা দেওয়ার রসিদ রয়েছে সরকারের কাছে।
ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেমের রায়ের দুদিন আগেও জামায়াতের নিয়োগ দেওয়া ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন করেন।সেসব ঘটনার দিকে ইংগিত করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তখন বলেছিলেন, একটা লোক যতভাবে বানচাল করার চেষ্টা করুক, আমরা আইনের শাসন বা আদালতের মর্যাদা যদি ঠিকমতো রাখতে পারি, তাহলে সব বিচারই হবে।
লবিস্ট ফার্ম ক্যাসিডি’কে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার-
মীর কাসেম যে যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করতে লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন- সেই অভিযোগের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে এ মামলার আপিল শুনানিতে একটি মেমো দাখিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। ওয়াশিংটনের ফার্ম ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ওই মেমোতে বলা হয়, তারা ‘পেশাগত সেবার’ জন্য মীর কাসেমের পাঠানো আড়াই কোটি ডলার হাতে পেয়েছেন।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের ওই মেমো উপস্থাপন করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচালে লবিস্ট ফার্মকে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার অভিযোগ এবং আসামিপক্ষের অস্বীকারের বিষয়টি তুলে ধরেই বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামির ২০১২ সালের ৯ জুন দাখিল করা জামিন আবেদনের সমর্থনেও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার তথ্যাদি দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের রেকর্ডে উল্লেখ করা হয়, তিনি (মীর কাসেম) একজন সফল ব্যবসায়ী।
বিচারকে ফ্রাস্টেট করে এটাকে নষ্ট করার চেষ্টা মির কাশেমের—
এসব প্রমাণিত সিদ্ধান্ত থেকে উপসংহার টানা যায় যে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করতে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করার সামর্থ্য রাখেন।ওই সময় মাহবুবে আলম বলেন, আদালত বলেছেন, তিনি (মীর কাসেম) লবিস্ট নিয়োগ করেছে কি করেন নাই- এটা প্রমাণসাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ২৫ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ব্যাপারে যে রসিদ দিয়েছিলাম, তা আদালত বিবেচনায় নিয়ে বলেছেন, মীর কাসেম আলী খুবই প্রতাপশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি বিচারকে ফ্রাস্টেট করে এটাকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রকম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
মাহবুবে আলম জানান, ট্রাইব্যুনালে এ মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশনের ভূমিকা নিয়ে আপিল বিভাগ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, দুইজন প্রসিকিউটর যার যার মত করে মামলার শুনানি করে গেছেন এবং নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করে গেছেন। এর ফলে এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলায় প্রসিকিউশনের কাজে সমন্বয়ের ঘাটতি থেকে গেছে।
ট্রাইব্যুনালে প্রধান প্রসিকিউটরের অধীনে প্রসিকিউটর দলে ‘অত্যন্ত অভিজ্ঞ’ দুজন থাকলেও ‘রহস্যজনক কারণে’ এ মামলা পরিচালনায় তাদের ওপর আস্থা রাখা হয়নি বলে মন্তব্য করা হয়েছে আপিলের রায়ে।সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, এই আসামি তখনকার সময়ে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। কুখ্যাত এই অপরাধী এমন এক দলের কমান্ডার ছিলেন, যে দল পরিচিত ছিল কিলিং স্কোয়াড হিসেবে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের আরও সতর্ক থাকা উচিৎ ছিল।
এদিকে ট্রাইব্যুনাল থেকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে এই রায়ের কপি পাঠানো হবে এবং মীর কাসেম আলীকে এই রায় সম্বন্ধে অবগত করা হবে।এরপর দণ্ড প্রক্রিয়ার পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা হবে।এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা ছাড়া মির কাশেমের প্রাণ রক্ষার আর কোন রাস্তা নেই।