কেন রাস্তায় নামেন না-বিএনপির কাপুরুষরা?
কাজী সিরাজ : গত ৫ জানুয়ারি ২০১৭ শাসক দল আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণতন্ত্র রক্ষা দিবস পালন করেছে। এর তিন দিন আগে সরকারের ক্ষমতার পার্টনার জাতীয় পার্টিও একই স্থানে তাদের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে বেশ জমকালো এক সমাবেশ করেছে। কিন্তু বিএনপিকে ৭ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ প্রশাসন। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, সরকার চায়নি বলেই বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। গণতন্ত্রের কথা বলে সরকার দুই দিন আগে সমাবেশে গলা ফাটিয়ে মাত্র দুই দিন পর যে দৃষ্টান্ত রাখল তা গণতন্ত্রের পক্ষে সুখকর বার্তা নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দিবসকে শাসক দল এবং তার নামধারী বামমিত্ররা বলছে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ আর বিএনপি ও তার মিত্ররা বলছে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’।
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যেখানে পরোক্ষে, প্রচ্ছন্নে সেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলছেন ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ দেখতে চান না বলে স্পষ্ট উচ্চারণের মাধ্যমে, সেখানে ওই দিনটিকে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে পালনের যৌক্তিকতা কতটুকু তা নিয়ে যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার একটি আদর্শ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ ও সে নির্বাচনকে অর্থবহ করার ব্যাপারে বিএনপির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিরোধটা ছিল নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। সরকারি দল যখন তাদের দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার অবস্থান থেকে সরে গিয়ে ‘সর্বদলীয় সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল, তাতে সম্মত না হয়ে বিএনপি বড় ভুল করেছে এবং নিজেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিজেদের দোষ ঢেকে ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করা সঠিক কিনা সে প্রশ্নও আছে। তবু আওয়ামী লীগ যখন তার কথা বলার সুযোগ নিচ্ছে, বিএনপিকেও তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।
এটা গণতন্ত্রের শিক্ষা। ভিন্ন মত প্রকাশে বাধা দেওয়া, অন্যের কণ্ঠরোধ করা আমাদের সংবিধানও অনুমোদন করে না। ৫ জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি দিনটি তাদের মতো করে উদযাপন করেছে। ১৮ জেলায় শাসক দল ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের খবর এসেছে মিডিয়ায়। বরিশালে বিএনপির অফিসই তছনছ করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের পুলিশের উপস্থিতিতে বেদম মারধর করেছে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। বিএনপির ‘বিশ্ববিখ্যাত’ কেন্দ্রীয় নেতারা এবারও কিন্তু ঢাকায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রাস্তায় তাদের টিকিটিরও দেখা মেলেনি।
এমন ঘটনা ও খবরের পরও বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখনও পত্রপত্রিকায়, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ‘টকশো’তে এমনকি রাজনৈতিক আড্ডায় আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গত বছরটি কেমন গেল, নতুন বছরটি কেমন যাবে। বিগত বছরের আলোচনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করা যায়— তাতে বিভিন্নজনের বিভিন্ন বিশ্লেষণ থাকতে পারে, ভিন্নধর্মী মূল্যায়নও থাকতে পারে। সালতামামি করাই যায়। কিন্তু আগামী বছরটি কেমন যাবে, এমন কোনো দৈবজ্ঞ নেই যে, চোখ বন্ধ করে সব কিছু বলে দিতে পারবেন এবং যা বলবেন তাই ঘটবে।
পুরনো বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন বছর সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়, আর করা যায় প্রত্যাশা। রাজনীতির প্রসঙ্গটাই আলোচনার সর্বাগ্রে। বলতেই হবে যে, ২০১৬ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত ছিল। সরকার একটা নিরুপদ্রব বছর কাটিয়েছে। উত্তাপহীন রাজনীতির পেছনে মাঠের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এবং তার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ কুটুম জামায়াতে ইসলামীকে কঠোরভাবে মোকাবিলার সরকারি কৌশল বেশ কাজ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার ও ফাঁসির দণ্ড এবং তা কার্যকর হওয়ায় খুবই বৈরী পরিস্থিতিতে পড়ে দলটি।
দেশব্যাপী তাদের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ হন— যদিও আইনি যুদ্ধ করে তাদের অনেকেই এখন ফের মুক্ত আলোয় বেরিয়ে এসেছেন। বাহ্যিকভাবে বোঝা যায়, সরকার তাদের বেশ কাবু করে ফেলেছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী মাঠে না থাকায় বা নামতে না পারায় দেশে ২০১৬ সাল শান্তভাবে পার হয়েছে। জামায়াত ছাড়া বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো লড়াই-সংগ্রামে বিএনপি যে অক্ষম তা-ও প্রমাণ হয়েছে।
এর আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় ঐক্যজোটের তিন মাসের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচিতে জামায়াতই যে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে সে বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে গত বছরের (২০১৬) লড়াই-সংগ্রামহীন, সরকারের ওপর কোনো ধরনের চাপহীন শান্ত পরিস্থিতিতে। এর অর্থ আবার এই নয় যে, বিএনপি জনসমর্থনহীন একটি কমিটিসর্বস্ব দল। বিএনপি মূলত সমর্থকনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল, যেখানে আওয়ামী লীগ, এমনকি জামায়াতে ইসলামীও ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দল। বিএনপির নীরব সমর্থকরা সুযোগ পেলেই দলের পাশে দাঁড়ায়, পক্ষে দাঁড়ায়। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে তার প্রমাণ মিলেছে। এমন নতুন একজনকে প্রার্থী করেও প্রায় এক লাখ ভোট পেয়েছে দলটি। সংগঠন যদি শক্তিশালী হতো, যদি দলে যোগ্য ও অবিতর্কিত নেতৃত্ব থাকত, জিততে না পারলেও লড়াইটা আরও জমাতে পারত বিএনপি।
তাই বলে একটি বড় রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে কিছুই করতে পারবে না, এটা খুবই হতাশাজনক। এ জন্য প্রয়োজন জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি, সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং যোগ্য ও সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, উপযুক্ত লোক উপযুক্ত জায়গায় নেই বলে বিএনপি এখন নেতৃত্ব-খরায় ভুগছে। ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদরা দলের নীতিনির্ধারণে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্তরে নেই বললেই চলে। যে কজন আছেন তা অনেকটা ড্রইং রুমের শোভাবর্ধনের জন্য সাজানো ‘শোপিস’-এর মতো।
শোনা যায় তাদের সঙ্গে তাদের নেত্রীর দেখা সাক্ষাৎ হয় কালেভদ্রে। নেত্রীর সঙ্গে মাঠকর্মীদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সরকারের জেল-জুলুম, মামলা-মোকদ্দমার জ্বালা-যন্ত্রণা আছে এটা ঠিক। বাংলাদেশে কোন সরকারের আমলে বিরোধী দল নিরাপদে ছিল? পাকিস্তান আমলে তো বটেই, বাংলাদেশ আমলেও বিরোধী দলকে বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই এগোতে হয়েছে। রাজনৈতিক সংগ্রাম কখনই একই গতিতে, একই তালে চলে না, এতে চড়াই-উত্রাই আছে, জোয়ার-ভাটা আছে, আছে উত্থান-পতনও। বিএনপিতে নেতৃত্ব সংকট ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ভাটা আর পতনের লক্ষণই স্পষ্ট। এত বিপুল-বিশাল জনসমর্থনকে তারা ক্যাশ করতে পারছে না।
নয়াপল্টনের প্রায় জনমানবশূন্য কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গেরিলা কায়দায় হঠাৎ হঠাৎ এসে ব্রিফিংবাজি ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম চোখেই পড়ে না। বড় বড় জনসভা আর বিক্ষোভ মিছিল ছাড়া একটি রাজনৈতিক দলের আর কোনো কর্মসূচি থাকতে পারে না? জনমত গঠনে লিফলেটিং, পোস্টারিং, ওয়ালিং (দেয়াল লিখন) শহরে-গ্রামে ছোট ছোট সভা-বৈঠক কত কিছুই তো হতে পারে। সরকার যখন বড় সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, অন্যান্য কর্মসূচি হাতে নিতে পারত বিএনপি। তা-ও নেয়নি। কেননা, ওই সব কর্মসূচিতে বিভিন্ন পদ-পদবিধারীদের যাওয়া-থাকা জরুরি। কিন্তু বিএনপির উঁচু পদ-পদবিধারীরা তা-ও ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন।
তাদের নিজেদের ‘আমলনামাতো’ নিজেদের জানা আছে। ভয়, যদি সে আমলনামা ধরে টান দেয় সরকার। একসময় পাওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষায় ঝুঁকি নিয়েছেন; দল ক্ষমতায় থাকাকালে এত বেশি ‘বানিয়েছেন’ অনেকে যে, এখন হারানোর ভয়ে রাস্তায় নামেন না। ২০১৬ সালে বিএনপির ‘প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড’ নেতাদের তাই টুঁ-শব্দ করতেও শোনা যায়নি।
ফলে সরকারকেও কোনো প্রকার পেরেশানিতে পড়তে হয়নি। ২০১৫ সালের ব্যর্থ, হঠকারী আন্দোলনের পর আমরা বহুবার বিএনপির মূল নেতৃত্বের কাছ থেকে শুনেছি যে, দল গুছিয়ে তারা সরকার পতনের আন্দোলনে নামবেন। কিন্তু ‘নয় মণ ঘি-ও জোটেনি, রাধাও নাচেনি’। আমরা সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কথা বলছি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, অগ্নিসংযোগ আর হত্যার মতো অরাজকতার কথা বলছি না। শান্তিপূর্ণ একটি কর্মসূচিও পালন করতে পারেনি বিএনপি। যদি তা পারত, আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা আরও গতিশীল হতো অবশ্যই। বিএনপির অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা এবং সরকারের কঠোর মনোভঙ্গি, ক্ষেত্রবিশেষে দলন-পীড়ন ২০১৬-কে রাজনৈতিক কলহমুক্ত একটি বছর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দেশে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের জন্য এ অবস্থাটা মোটেও উপযোগী না হলেও রাষ্ট্রের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন কিন্তু বেশ আছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশে এসে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করে আরও অপার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েনের অবসান হয়েছে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার কৃতিত্ব শেখ হাসিনার সরকারকে দিতেই হবে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণার বছর হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও গোষ্ঠী বাংলাদেশকে এখন বেশ সমীহ করছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি বহু বছর ৬ শতাংশের কঠোর বৃত্তে আবদ্ধ ছিল। ২০১৬ সাল সে বৃত্ত ভেঙে দিয়েছে। আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি এবার ৭ শতাংশের ঘরও অতিক্রম করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে। এখন তা পৌঁছেছে ৩২ বিলিয়ন ডলারে। মূল্যস্ফীতিও বলতে হবে সহনীয় পর্যায়ে ছিল ২০১৬ অর্থবছরে। এটাও সরকারের কৃতিত্ব। বিদেশি ঋণ-সহায়তা বিদায়ী বছরে বাড়ার প্রবণতায় ছিল। রাজস্ব আদায়ের গতিও ছিল আশাপ্রদ। এনবিআর তার লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে। এ সবকিছুর পেছনে দেশের শান্ত ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবদানই বেশি। কিন্তু অন্য নেতিবাচক দিকও আছে। বিগত বছরগুলোতে দেশে গণদারিদ্র্য কমেছে। গ্রামে গেলে এটা চোখে পড়ে। এখন গ্রামে খালি পায়ে হাঁটা মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। যুব-তরুণদের অধিকাংশের পরনে এখন লুঙ্গির স্থলে প্যান্টের আধিক্য দেখা যায়। মানুষ আগের মতো অবস্থাপন্নদের কাছে অন্নের জন্য হাত পাতে না। ঘরবাড়ি নির্মাণ, মেয়ের বিয়েশাদি এবং চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চায়। এটাকে গ্রামীণ জীবনধারায় একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন হিসেবে নিলেও নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে গণদারিদ্র্য কমলেও ধনবৈষম্য বেড়েছে মারাত্মকভাবে। এই বৈষম্য অব্যাহত থাকলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন-অগ্রগতির সুফল ভোগ করবে সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষ। জাতির অর্থনৈতিক অগ্রগতি-প্রবৃদ্ধি যদি দেশের সিংহভাগ জনগণের কোনো কল্যাণে না আসে, সে উন্নয়ন-সমৃদ্ধি জনমনে ক্ষোভ ও ক্রোধের জন্ম দেয়। দিনে দিনে পুঞ্জীভূত সে ক্ষোভ ও ক্রোধ হঠাৎ কখনো দ্রোহে রূপান্তরিত হতে পারে। তাতে শাসকের ভিত ও শোষকের ‘নিদ’ (নিদ্রা) বিনাশ হতে পারে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দল ‘আগে উন্নয়ন ও পরে গণতন্ত্র’ বা ‘বেশি উন্নয়ন কম গণতন্ত্র তত্ত্ব’ চালু করেছে। রাষ্ট্র শাসনে সরকার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করছে প্রতিপক্ষের। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে চার দেয়ালের মধ্যে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এটা আরেক ধরনের কারাগার। বিএনপি সেই কারাগারের ‘লৌহ কপাট’ ভাঙতে পারেনি।
২০১৬ সালে জঙ্গিবাদ রক্তচক্ষু দেখালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্পরতায় তা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারেনি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করেছে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথে ‘স্কিমিং ডিভাইস’ বসিয়ে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে টাকা লোপাটের পর এই অনাস্থা আরও বেড়ে যায়। এই দুটি ঘটনা আমাদের আর্থিক খাতের নিরাপত্তা সংকট স্পষ্ট করেছে। ২০১৭-তে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন যেন হতে না হয়। ২০১৬ সালে একটি অশনি সংকেত আছে— তা হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নগতি। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতাও কাটাতে পারেনি ২০১৬। নতুন বছরে এ বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দ রাজনীতিতে তিনটি সুখবর দিয়েছে জাতিকে। ১. ওই বছর দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বিবাদে, ২. নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে আনন্দঘন পরিবেশে, ৩. নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু হয়েছে এবং প্রধান দুটি দলই তাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। সবার মনে আশা জেগেছে যে, রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ সফল হবে এবং সবার কাছে মোটামুটি মেনে নেওয়ার মতো একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে আগামী মাসে (ফেব্রুয়ারিতে)। এ-ও আশা করা হচ্ছে যে, কমিশনটি ঠিকভাবে গঠনের পর আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনটিও অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের মতো। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ও সরকার দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে আরও উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে।
এক্ষেত্রে আবারও শুরুর প্রসঙ্গে যেতে হবে। কোনো নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে অর্থবহ করার ক্ষেত্রে শুধু সরকারপক্ষ নয়, বিরোধীপক্ষকেও যোগ্য ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হয়। আগামী নির্বাচনকে অর্থবহ করতে হলে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপিকে দৃশ্যমান ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আন্দোলনে মাঠে না থাকার সরাসরি অভিযোগ করেছেন তিনি। একসময় আওয়ামী লীগের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে যেখানে অহংকার করে বলেছিলেন, ‘আপনাদের মোকাবিলার জন্য আমার ছাত্রদলই যথেষ্ট’ সেই ছাত্রদলের আজ এ ভঙ্গুর ও জরাজীর্ণ দশা কেন তা কি ভেবেছেন ম্যাডাম খালেদা দিয়া? সুন্দর ‘ফলদ বাগান’ নিজ হাতে ধ্বংস করে আগাছা-পরগাছার জঙ্গল বানিয়ে এ বাগান থেকে সুস্বাদু ফল আশা করা কি সঙ্গত? অছাত্র, বিবাহিত, বয়স্ক ব্যক্তিদের দিয়ে ছাত্র সংগঠন হয় না এটা না বোঝার কথা নয়। কিন্তু কমিটি গঠনে অস্বচ্ছ, অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে ছাত্রদলকে একটি অক্ষম সংগঠনে পরিণতি করেছেন দলের ‘নেতারা’ই। ছাত্রদলের জেনুইন অনেক নেতা-কর্মী এ অভিযোগ হরহামেশাই করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? এখন ‘মান্দার’ গাছ থেকে আম-কাঁঠাল ফল চেয়ে কী লাভ? ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়তে গিয়ে দলীয় নেতাদেরও ‘একহাত’ নিয়েছেন বেগম জিয়া। আন্দোলনে তারাও মাঠে ছিলেন না বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এই নেতাদের বেগম জিয়া দেরিতে চিনলেন। দলের সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া তাদের চিনেছিলেন অনেক আগে। তাই দলকে দুর্নীতি, দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করার জন্য তিনি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে এই ব্যক্তিদের হটিয়ে দলে নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে বলেছিলেন; সৎ, দুর্নীতিমুক্ত সাহসী তরুণদের নেতৃত্বের উপরিকাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছিলেন, ভোগবাদ ও লুণ্ঠন সংস্কৃতি পরিহার করে আদর্শবাদ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থে বিএনপিকে জিয়ার বিএনপিতে পরিণত করার কথা বলেছিলেন। বিলম্বে হলেও ম্যাডাম সেসব সত্য এখন উপলব্ধি করছেন। একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আদায় করার জন্য এবং একটি অর্থবহ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য বিএনপিকে যোগ্য ও প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে হলে, যাদের বিরুদ্ধে বেগম জিয়া নিজ মুখে অভিযোগ করেছেন, সেসব আবর্জনা সাফ করতে হবে। তা না হলে এই ভীতু-কাপুরুষ নেতৃত্ব দিয়ে বিএনপি যেমন লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, তেমনি ভালো নির্বাচন ও কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ও কোনো অবদান রাখতে পারবে না।