কৃষ্ণকুমারী, বীরাঙ্গনা কাব্য ও ব্রজাঙ্গনা-মধুসূদন দত্ত
মাহবুব আলম: সাধারণ শিক্ষিত বাঙালির সঙ্গে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রথম পরিচয়ের পালা শুরু হয় বাল্যে, স্কুলজীবনের গোড়াতেই সেই বাল্য-কৈশোরে পড়া ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতার ‘রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে’—এমন অপূর্ব ছন্দে যে মুগ্ধবোধ জন্মেছিল তা আজও অক্ষয় হয়ে আছে আমাদের স্মৃতিতে।
একটু ওপরের ক্লাসে উঠলেই মেঘনাদ বধ কাব্য-এর বাছা বাছা দু-একটি অংশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল সে আমলে বাঁধাধরা।
আমার ক্ষেত্রে মধুসূদনের বিশাল প্রতিভা ও ব্যক্তি মধুসূদনের বিষাদময় করুণ ট্রাজেডি আঁচ করার কিছুটা সুযোগ হয় ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ঢোকার পর। বনফুলের মধু কবিকে নিয়ে লেখা শ্রী মধুসূদন নাটকটি ইন্টারমিডিয়েটের বাংলা সিলেবাসে অবশ্যপাঠ্য ছিল সে সময়ে। সেই নাটকে তরুণ মধুর একটি দাম্ভিকতাপূর্ণ সংলাপ আমাদের কলেজের ছাত্রমহলে খুব চাউর হয়েছিল—‘রাজনারায়ণগঞ্জ দত্তের ছেলে কাউকে গুনে টাকা দেয় না।’ সেই অভাব-অনটনের ছাত্রজীবনে হাতখরচের পয়সা জোগানোর চিন্তায় জেরবার আমাদের মনে হয়েছিল, মধুর কী বুকের পাটা! তিনি তখন আমাদের কাছ রূপকথার এক রাজপুত্র।
পরবর্তীকালে কলকাতায় ব্যারিস্টারি করার সময়ে মধুসূদন ধনী না হয়েও মক্কেলের হাত থেকে অনেক সময়ই গুনে টাকা নিতেন না। আইন ব্যবসায়ে উপার্জনের জন্য যে রকম পেশাদারি মনোভাব নেওয়া উচিত, তা তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। মামলা চালিয়েছেন কিন্তু ফি নেননি এমন উদাহরণ তাঁর জীবনীতে অজস্র।
মামলা উপলক্ষে মধুসূদন একবার ঢাকায় এসেছেন, ঢাকার গুণগ্রাহী নাগরিকেরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। সংবর্ধনার উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি শুধু বাঙালি নই, আমি বাঙাল। আর তা যদি ভুলে যাই, সেই জন্য আমার শোবার ঘরে একটি আয়না রেখেছি সে আয়না বলে দেয় যে আমি কৃষ্ণকায়!’
১৮৫৯ থেকে ১৮৬২-এর মধ্যে মধুসূধন লিখলেন, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, মেঘনাদ বধ কাব্য, কৃষ্ণকুমারী, বীরাঙ্গনা কাব্য ও ব্রজাঙ্গনা কাব্য।
অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা মেঘনাদ বধ কাব্য মধুসূদনকে যেমন যশ, প্রশন্তি ও আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল, তেমনি সৃষ্টি করেছিল একদল মধুবিদ্বেষী, তাঁরা অচিরেই মেঘনাদের প্যারোডি বের করলেন ‘ছুচুন্দর বধ কাব্য’ নাম দিয়ে। অমিত্রাক্ষর ছন্দের আদলে ব্যঙ্গ করে লিখলেন, ছুতোরের টেবিল বানানোর কাব্য—
‘টেবলিলা সূত্রধর, বাটালিয়া কাষ্ঠ
লাঙ্গলিনা ক্ষেত্র চাষা, হলদিয়া মাঠ।’
আত্মবিশ্বাসী মধুসূদন এহেন সমালোচনায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তিনি এবার গীতরসসমৃদ্ধ এক ভক্তিরসের কাব্য বা পদাবলি লিখে সবাইকে বিস্মিত করে দিলেন। বাঙালি পাঠক তাঁর ব্রজাঙ্গনা কাব্য-এর মাধ্যমে নতুন করে পদাবলির আস্বাদ পেলেন।
রাজনারায়ণ বসুর জবানী ও সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কলমের মাধ্যমে আমরা মধুকবির সুবিখ্যাত ব্রজাঙ্গনা কাব্য নিয়ে একটি চমৎকার কাহিনি পেয়েছি।
ব্রজাঙ্গনা কাব্য তখন সবেমাত্র বেরিয়েছে। বলা বাহুল্য, বের হওয়ার সঙ্গেই মধুসূদনের প্রতিভার এক নতুন দিক উন্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি সাড়া পড়ে গেল পাঠকমহলে। উল্লেখ্য, সেই যুগে পাঠকদের পক্ষে এখনকার মতো নতুন লেখকদের সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত জানার সুযোগ ছিল না। এসব সত্ত্বেও কেমন করে যেন ব্রজাঙ্গনার একটি খণ্ড নবদ্বীপের এক সাহিত্যরসজ্ঞ পণ্ডিতের হাতে পৌঁছেছিল। বইটির ভাব ও ভাষা তাঁকে এতটাই অভিভূত করল যে, তাঁর মনে হলো, ব্রজাঙ্গনার কবি একজন প্রকৃত ভক্ত সাধক ও প্রেমিক।
এই কবিকে একবার দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি। নবদ্বীপ থেকে কলকাতা খুব কাছে নয়। সেকালে নদীপথে ছাড়া কলকাতায় স্থলপথে পৌঁছানো সহজসাধ্যও ছিল না। পণ্ডিত বহু কষ্ট ও যথেষ্ট অর্থ ব্যয়ে নৌকাযোগে কলকাতা পৌঁছুলেন। মধুসূদনের খোঁজ করে জানতে পারলেন, মধুসূদন প্রায় প্রতিদিন বৌবাজারে ‘স্টান হোপ’ এসে এসে তাঁর বইয়ে প্রুফ দেখেন।
পণ্ডিত হাজির হলেন সেই প্রেসে। এখানে তিনি যে প্রেস-কর্মচারীকে সামনে পেলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, মধুসূদন কোথায়? আমি তঁাকে একবার দেখবো।’ হতভম্ব কর্মচারী তাঁর কথা বুঝতে পারছেন না দেখে পণ্ডিত আবার বললেন, ‘আমি শ্রীধাম নবদ্বীপে আমার নিবাস। আমি ব্রজাঙ্গনা কাব্য-এর কবি বৈষ্ণব কুলচূড়ামণি কবিশেখর পবমভক্ত মধুসূদনের সাক্ষাৎ প্রার্থী’। মধুসূদন যে খ্রিষ্টান এবং তার বেশভূষা, জীবনযাপন—সবই যে বৈষ্ণবভক্তের বিপরীত, এ তথ্য পণ্ডিতের তখনো অজানা।
এদিকে ততক্ষণে প্রেস-কর্মচারীর বুঝতে বাকি রইল না কোন মধুসূদনের সাক্ষাৎপ্রার্থী এই পণ্ডিত। পণ্ডিতকে তিনি বললেন, ‘আপনি মাইকেলের সঙ্গে দেখা করতে চান। তাই বলুন। ভেতরে যান, সামনের ঘরেই তাঁকে পাবেন।’
পণ্ডিত এবার আনন্দে আত্মহারা। তাঁর আশা পূর্ণ হবে। প্রফুল্লচিত্তে প্রেসের সামনের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।
মধুসূদন তখন সেই ঘরে গভীর মনোযোগে বইয়ের প্রুফ দেখছিলেন। পণ্ডিত ঘরে ঢুকে দেখলেন, একটা ‘জোয়ান মরদ মেটে ফিরিঙ্গী’ সাহেবি ‘পোশাক’ পরা, কাগজে কী যেন লিখছে। এই মূর্তি দেখে ভড়কে গেলেন পণ্ডিত। তাঁর আর সন্দেহ নেই যে তিনি ভুল কামরায় ঠুকে মহা অন্যায় করেছেন। ভয় হলো, এবার ফিরিঙ্গিটা তাঁর অনধিকার প্রবেশের জন্য গাল-মন্দ না করে। দু-এক মিনিট হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। এরপর যখন নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছেন ঘর থেকে, তখনই কাগজ থেকে মুখ তুললেন সেই কালো গোঁফধারী ফিরিঙ্গী। পণ্ডিতের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কর্কশ কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য কোমল করে বললেন, ‘ঠাকুর, আপনি এখানে কী চান?’ পণ্ডিত কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘আমি ব্রজাঙ্গনা কাব্যের মহাকবি সাধক মধুসূদনকে দেখে চক্ষু সার্থক করতে এসেছি। কিন্তু অক্ষতাবশত, ভুল করে এই ঘরে ঢুকে পড়েছি। শুনেছি, তিনি এই ছাপাখানায় আছেন। একবার তাঁকে দেখবো এই আশায় বহুদূর নবদ্বীপ থেকে এসেছি। কোন কক্ষে সাক্ষাৎ পাবো, দয়া করে বলবেন কি?’
মধুসূদন উঠে দাঁড়িয়ে সেই দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ পণ্ডিতের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বিনীতভাবে বললেন, ‘ঠাকুর, আমিই ব্রজাঙ্গনা কাব্যের লেখক মধুসূদন দত্ত।’
মধুসূধনের এ কথায় বিস্ময়ে দু-তিন মিনিট নির্বাক পণ্ডিত। তারপর অস্ফুট কণ্ঠে ধীরে ধীরে বললেন মধুসূদনকে, ‘বাবা, তুমি শাপভ্রষ্ট।’
দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখেছেন, অতি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য—‘কিন্তু সহস্র কথা বলিলেও তদ্বারা মধুসূদনের চরিত্রগত বিশেষত্ব অধিকতর পরিস্ফূত বুঝাইবার সম্ভাবনা ছিল না।’