কাল সকালটা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আক্তার সরদারের
বিশেষ প্রতিনিধি : কাল বৃহস্পতিবার ২৬ এপ্রিল এর সকালটা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আক্তার সরদারের। এই দিনে তিনি বাংলাদেশের মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর দরবারে চলে যান। রেখে যান নানা ইতিহাস ও স্মৃতি। ঢাকার ইতিহাসবিদরা জানান, অতীতে ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েত সরদাররাই সমাজব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। যাঁরা সরদার নির্বাচিত হতেন তাঁদের পাগড়ি পরিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করা হতো।
তেমনি একজন সরদার ছিলেন মগবাজারের আক্তার সরদার। তাঁকে বলা হতো ঢাকার জীবিত শেষ সরদার। গত বছর ২৬ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি মারা যান ৮৫ বছর বয়সে। ঢাকার জীবন্ত সরদারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী।তাঁর বাড়িটি ‘মগবাজার সরদার বাড়ি’ নামে এখনো খ্যাত।
ঢাকার ইতিহাসে উল্লেখ আছে ওসমান গনি সরদার নবাব সলিমুল্লাহর কাছ থেকে পাগড়ি পরে সরদারি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর দুই ছেলে আক্তার সরদার ও শাহাবুদ্দিন সরদার একই দায়িত্ব পালন করেন।ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানবিরোধী সব আন্দোলনে ঢাকার হাতে গোনা যে কজন সরদার নেতৃত্ব দেন এর মধ্যে আক্তার সরদার ছিলেন অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেন।
একাত্তরে মগবাজারের সরদার বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আশ্রয়কেন্দ্র। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পর যখন কেউ প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করার সাহস পাননি, তখন তিনি শুধু এর প্রতিবাদই করেননি নিজের বাড়িকে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার জন্য ছেড়ে দেন।এরপর- পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে কেউ ১৫ আগস্ট পালনের সাহস না করলেও আক্তার সরদার মগবাজার মোড়ে গরু জবাই করে মাইকে শেখ মুজিবের ভাষণ বাজিয়ে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছেন।
এ সম্পর্কে আক্তার সরদারের ভাতিজি এবং সাবেক সংসদ সদস্য আসমা জেরিন ঝুমু বলেন, তিনি এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন এবং সাতষট্টির ছয় দফা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য প্রথম মশাল মিছিল মগবাজার মোড় থেকে বের হয় আক্তার সরদারের নেতৃত্বে। এতে কয়েকজন নিহত হওয়া ছাড়াও তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে তাঁর মা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।’
সরদার বাড়ির টানে প্রধানমন্ত্রী..
এই সেই সরদার বাড়ি যার টানে গতবছর মগবাজারে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।ওই দিন শুক্রবার বিকেলে ৫১ মিনিট সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাটিয়েছিলেন সরদার বাড়িতে । ওইদিন বিকেলে যখন প্রধানমন্ত্রী সরদার বাড়িতে এসেছিলেন তখন এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল। সবাই বলাবলি করতে থাকেন শেখ হাসিনা অতীত ভোলেননি বলেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সহযোগীদের খোঁজ-খবর নিতে সরদার বাড়িতে এসেছেন।
আসমা জেরিন ঝুমু বলেন, সেদিন শেখ হাসিনা আক্তার সরদারের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন এ বাড়ির সঙ্গে আমার বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এ বাড়ির অনেক অবদান। তবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আক্তার সরদারকে আমার দেখার বড় শখ ছিল। কিন্তু বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাজের ব্যস্ততার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি।
অনেক স্মৃতিবিজড়িত সরদার বাড়িতে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আক্তার সরদারের কর্মময় জীবন। এ বাড়িতে আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার স্মৃতি রয়েছে। অনেকে এখানে এসে খাওয়া-দাওয়া করেছেন।
একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ বাড়ি থেকে খাবার সরবরাহ করা হতো। আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ঘটনাও জানা যায়। এসব কিছুর মূলে ছিলেন আক্তার সরদার।ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয় পুরো পরিবার। তারা কিছুক্ষণের জন্য হলেও শোক ভুলে যান।
আক্তার সরদার এর জন্যে প্রধানমন্ত্রীর এই উদারতা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না বলে জানান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোক্তার সরদার। আক্তার সরদার শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনাকে কতটা ভালোবাসতেন তার একটি ঘটনা তাঁরা শেখ হাসিনাকে জানান আসমা জেরিন ঝুমু।
সেটা হলো, টেলিভিশনে শেখ হাসিনার ভাষণের সময় কোনো হইচই তাঁর কানে এলেই দূর থেকে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে জানতে চাইতেন—‘আমার নেত্রীর কী হইছে!’ তাঁরা আরো জানান, আক্তার সরদার খুব সিগারেট খেতেন। অনেক সময় অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
কারো কথা শুনতেন না। যদি পরিবারের কেউ বলতেন, ‘আপনার সিগারেট খাওয়ার কথা শেখ হাসিনার কানে গেছে।’ তখনই বলতেন, ‘সত্যি আমার নেত্রীর কানে এ খবর গেছে? না এখন থেকে আর সিগারেট খাব না’—এই বলে সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট ফেলে দিতেন। এসব কথা শুনে শেখ হাসিনা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হওয়ায় এই সরদার বাড়ির অনেকের ওপর বিভিন্ন সময় অনেক নির্যাতন-নিপীড়ন ও জেল-জুলুম হয়েছে। নির্যাতনে অনেকের অঙ্গহানিও হয়েছে। জিয়া-এরশাদ অনেক চেষ্টা করেও আক্তার সরদারকে তাঁর আদর্শ থেকে টলাতে পারেননি।
আক্তার সরদারের ভাই শাহাবুদ্দিন সরদারের মেয়ে আসমা জেরিন ঝুমু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফের পাশে মানবঢাল হয়ে নেত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে গুরুতর জখম হয়েছিলেন।