কার জিঘাংসায় কেন খুন হলো হাসান খালেদ?
বিশেষ প্রতিনিধি : কার জিঘাংসায় কেন খুন হলো হাসান খালেদ? এ প্রশ্ন এখন নিহতের স্বজনদের।তাঁরা এই খুনের রহস্য মেলাতে পারছেন না।ওষুধ আনতে গিয়ে একজন ব্যবসায়ী নেতার লাশ মিলল! পুলিশ এখনও এ খুনের কোন কিনারা করতে পারল না এটা কি ভাবা যায়-বললেন স্বজনরা।
এদিকে ডাচ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিবিসিসিআই) এর সভাপতি হাসান খালেদ নিখোঁজের পরে নিহত হওয়ার ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সহসাই কোথাও যাচ্ছেন না কেউ।
ব্যবসায়ীরা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সরকার ও ব্যবসায়ী নেতাদের। এদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ ব্যবসায়ীদের এক ই-মেইল বার্তা দিয়ে চলাচলে অতিরিক্ত সতর্ক হওয়ার জন্য বলেছেন।
গত ২৩ জুলাই সকালে ধানমন্ডির ৪/এ রোডের ৪৫ নম্বর বাসা থেকে বের হয়ে ওষুধ আনতে গিয়ে নিখোঁজ হন ডিবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হাসান খালেদ। তাকে অপহরণ করা হতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়ে পরের দিন ২৪ জুলাই তার শ্যালক শরীফুল আলম ধানমন্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। যার জিডি নম্বর-১০৫৫। ২৬ জুলাই হাসান খালিদের লাশ কামরাঙ্গীরচর থানাঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়।
ব্যবসায়ী সমাজে পরিচিত মুখ এ ব্যবসায়ী নেতার নিখোঁজ হওয়া ও নদীতে লাশ পাওয়া যাওয়ায় দেশের ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে।চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ ব্যবসায়ীদের একটি ব্যক্তিগত ই-মেইল বার্তা দিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন। অপরিচিত জায়গায় যেতে নিষেধ করেছেন।
ইংরেজিতে দেওয়া ই-মেইল বার্তায় সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি এক পর্যায়ে লিখেছেন,We should be now extra careful on our movement, restrain from visit to unknown places and reach home as early as possible. (চলাফেরায় এখন থেকে আমাদের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত, অপরিচিত জায়গায় যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং যতদ্রুত সম্ভব বাসায় পৌঁছাতে হবে)।
যদিও বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের নিয়ে সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন এফবিসিসিআই সভাপতি। সেখানে তিনি বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বিদেশীরাও কাজ করছেন স্বাভাবিকভাবেই।
অপরদিকে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের(এমসিসিআই) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর একই সময়ে বলেছেন, সব জায়গায় নিরাপত্তার জন্য সরকার এখন যে সাপোর্টটা দিচ্ছে, এটা অনবরত দিয়ে যেতে হবে। তাহলে সবার আস্থা ধরে রাখা যাবে।
সম্প্রতি গুলশান ও কিশোরগঞ্জের ঈদগাহে জঙ্গি হামলায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে পুরো দেশের জনসাধারণের মনে। এর পরেই কল্যাণপুরের ঘটনা সেই শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন সময়ে ব্যবসায়ী নেতার লাশ উদ্ধার হওয়ায় দেশে-বিদেশে ঢাকার নিরাপত্তা ইস্যুটি ফের আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
শঙ্কিত অবস্থায় জীবন-যাপন করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। অন্যান্য চেম্বার সভাপতিদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ও ব্যবসায়ী মহলে। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোথাও যাচ্ছেন না কেউ। সবসময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন অনেকেই।
২৩ জুলাই হাসান খালেদ বাসা থেকে বের হওয়ার পরে সিঁড়িতে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয় হাসান খালেদের। তার স্ত্রী মর্নিং ওয়াল্ক (সকাল বেলার হাটা) করে ফিরছিলেন। স্ত্রীকে জানান ওষুধ আনতে নিচে যাচ্ছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, সকালে নাস্তা করার আগে ওষুধ খেতে হয় হাসান খালিদের। নাস্তার টেবিলে বসে দেখেন ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের বলেন, নিচে ওষুধ আনতে যাচ্ছি। একথা বলেই খালেদ বাসার নিচে নেমে যান। আর বাসায় ফেরেননি তিনি। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে খালিদের মোবাইলে ফোন দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এর পর থেকেই পরিচিত ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে তার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়। সারাদিন খোঁজ না পেয়ে পরে থানায় জিডি করা হয় স্বজনদের পক্ষ থেকে।তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, সকালে নাস্তা করেই অফিসে যাওয়ার কথা ছিল হাসান খালিদের। সারাদিন অফিসে না যাওয়ায় উৎকণ্ঠা বেড়ে যায় তাদের।
বাসার নিচ থেকে তাকে কারা তুলে নিয়ে গেল এ নিয়ে পুলিশ কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি এখনো। কিভাবে এবং কারা তাকে তুলে নিয়ে গেল, এত সকাল বেলায় তাকে তুলে নেওয়া হলো, কেউ তা দেখলো না, কোন ধরণের হইচইও হলো না- এমন অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে পরিবারের সদস্যদের মনে।পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এসব বিষয় এবং তার মোবাইলের কললিস্ট যাচাই করলে অনেক কিছু পাওয়া যেতে পারে।
জানা গেছে, নিহত ব্যবসায়ী নেতা হাসান খালেদ ছিলেন খুবই মিশুক প্রকৃতির। সজ্জন হিসেবে ব্যবসায়ী মহলে তার খ্যাতি রয়েছে। ধানম-ির ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। তার কোন ব্যবসায়ীক বা ব্যক্তিগত শত্রু থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করছেন না ব্যবসায়ী ও পরিবারের লোকজন।
পরিবার সূত্র জানিয়েছে, হাসান খালেদের লাশ পাওয়ার পরে পরিবারের সদ্যসদের পুলিশের পক্ষ থেকে শুরুতে জানানো হয়েছিলো, তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন। তবে পুলিশের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হননি পরিবারের কোন সদস্য বা তার সহকর্মীরা কেউ। তারা বলছেন, নিখোঁজ হওয়ার পরে তাকে অপহরণ করা হয়েছে উল্লেখ করেই থানায় জিডি করা হয়েছিল। আমাদের জানা মতে খালিদের কোন শত্রু নেই।
আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন তিনি। কেমিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন হাসান খালেদ। তার অফিস রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের হাসান হোল্ডিং ভবনের অষ্টম তলায়।
গত ২৫ বছর ধরে তিনি আমদানি-রপ্তানি ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ডাচ-বাংলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ গঠনে উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনিও একজন।
এছাড়াও খালেদ বাংলাদেশের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের বাণিজ্যের উন্নয়নে ট্রেড ফ্যাসিলিটেটর হিসেবেও কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। তার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার পূর্ব জয়পুর গ্রামে।