‘কারখানা নিরাপদ না করলে পোশাক কিনবে না বিদেশীরা’
বিশেষ প্রতিবেদন : ইউরোপীয় ক্রেতাদের উদ্যোগ অ্যাকর্ডের নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েজ বলছেন, “কারখানাগুলোকে সংস্কার কাজ শেষ করতেই হবে। যারা করবেনা তাদের কাছ থেকে পোশাক কেনা হবেনা। কোন কোন কারখানা মালিক একাজে পিছিয়ে আছে। কিন্তু আমরা আশা করছি তারা এটা শেষ করবে।
তিনি বলেন, যেসব কারখানাগুলো বিদেশী ক্রেতাদের সাথে ব্যবসা করছে সেগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। এখনো অনেক কারখানা সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি।প্রায় চার বছর আগে এক সকালে বিকট শব্দে ধসে পড়ে সাত তলা বিশিষ্ট রানা প্লাজা। ধংসস্তুপ থেকে একের পর এক বের করে আনা হচ্ছিল শ্রমিকদের মৃতদেহ। মরদেহ গণনা যেন শেষই হচ্ছিল না। দু সপ্তাহের উদ্ধার অভিযানে শেষ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাড়ায় ১১৩৪জনে।
এই ঘটনা শিল্প মালিকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে শ্রমিক নিরাপত্তাকে তারা কতটা অগ্রাহ্য করেন। কিন্তু এই তিন বছরে পরিস্থিতির কতটা বদলেছে? ঢাকার কাছে আশুলিয়ায় কর্মরত কয়েকজন শ্রমিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে প্রশ্ন।আব্দুল হাকিম নামের একজন শ্রমিক বলেন, “আগের চেয়ে এখন নিয়ম-কানুন ভালো হইছে। নিরাপত্তাটা বাড়ছে।”
তিনি জানালেন, কারখানার জরুরী নির্গমন পথ এখন সবসময় পরিষ্কার রাখা হয় যাতে অগ্নিকাণ্ড হলে শ্রমিকরা দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারে।আরেকজন শ্রমিক জেসমিন আক্তার জানালেন, তিনি কারখানায় কাজ করেন সেখানে মাসে কয়েকবার অগ্নি নির্বাপনী মহড়া হয়।
শ্রমিকরা আজ যে পরিবর্তনের কথা বলছেন, সেটি এমনিতেই আসেনি। প্রায় সাড়ে এগারোশো শ্রমিকের মৃতদেহ সে পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করেছিল।গত তিন বছরে নানা উদ্যোগ, নানা চাপের মাধ্যমে এর সূচনা হয়েছে। রানাপ্লাজা ধ্বসের পর তৈরি পোশাক খাতের নিরাপত্তার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া
কাজের নিরাপদ পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটি সবাই বুঝতে পেরেছে শতশত শ্রমিকের প্রাণহানির বিনিময়ে।তৈরি পোশাক খাতের কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বললেন রানা প্লাজা ধসের ঘটনা মালিকদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে অবহেলা করা যাবেনা।
মি: রহমান বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা হলো উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে। সবাই বুঝতে পেরেছে শ্রমিকের নিরাপত্তা সবার আগে।”রানাপ্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো নিরাপদ করার উদ্যোগ শুরু হয়। এই উদ্যোগ আসে প্রথমে বিদেশীদের দিক থেকে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক এবং মানবাধিকার সংগঠনের চাপে পড়ে এই উদ্যোগে সামিল হয় ইউরোপ এবং আমেরিকার ক্রেতারা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারও সম্পৃক্ত হয় এই উদ্যোগে।
সাড়ে তিন হাজার তৈরি পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত কারার কার্যক্রম শুরু হয়। এই কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ভবন কতটা নিরাপদ সেটি পরীক্ষা করা। পাশাপাশি কারখানার বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ঝুঁকি মুক্ত করা এবং অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করা।
কিন্তু গত তিন বছরে এসবের ফলাফল কী হয়েছে? ইউরোপিয়ান ক্রেতাদের উদ্যোগে গঠিত হয় অ্যাকর্ড অন ফায়ার এন্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ –এর নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েজ। তারা প্রায় ১৭০০ কারখানা পরিদর্শন করেছেন।
মি: ওয়েজ বলেন, “তিন বছর আগের তুলনায় পোশাক কারখানা এখন অনেক নিরাপদ। নিরাপত্তার জন্যে ন্যূনতম যে বিষয়গুলো দরকার সেগুলো মাথায় রেখেই কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছি।ভবনগুলোর নিরাপত্তা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।”
নিরাপত্তার শর্ত পূরণ করতে না পারায় ৩০টির বেশি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেসব কারখানা বন্ধ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কিছু কারখানা স্থানান্তর করা হচ্ছে।পরিদর্শনের পর কারখানাগুলোকে বিভিন্নভাগে ভাগ করা হয়েছে।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলছেন সংস্কার কাজ যেন দ্রুত শেষ হয় সেদিকে তারা নজর রাখছেন।মি: হক বলেন, “ আমি শ্রম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আল্লাহর উপর ভরসা করে বলতে পারি, বাংলাদেশে রানা প্লাজার মতো দ্বিতীয় আরেকটি ঘটনা ঘটবেনা।”
রানাপ্লাজা ধসের পরে যে বিষয়টি সমালোচনায় এসেছিল তা হচ্ছে পর্যাপ্ত সংখ্যক কারখানা পরিদর্শক ছিলনা। প্রায় চার হাজারের মতো কারখানা থাকলেও নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য পরিদর্শক ছিল অল্প কিছু। অভিযোগ ছিল কার্যত কোন পরিদর্শন ব্যবস্থা কাজ করতো না।শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হককে জিজ্ঞেস করেছিলাম এ দিকটায় কোন উন্নতি হয়েছে কিনা? শ্রম প্রতিমন্ত্রী জানালেন কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরে এখনো পর্যন্ত ৩৫০জন পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে পরিদর্শকের সংখ্যা ৫৫০জনে উন্নীত করা হবে।
নিরাপত্তার প্রশ্নে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তার সবটাই এসেছে বিদেশীদের চাপে। এসব সংস্কার শুরু করতেও কিছু-কিছু মালিক নানা টালবাহানা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে মালিকরা যতটা না নিজে এগিয়ে এসেছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে বিদেশী ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য।
তবে যেভাবেই হোক খানিকটা হলেও পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ ।মি: আহমেদ বলেন, “ আমরা দেখতে চাই মালিক করতেছে। সে কতখানি চাপে করতেছে আর কতখানি নিজের ইচ্ছায় করেছে, সেটা আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় না।”
যেসব কারখানা পরিদর্শন হয়েছে সেগুলো বিজিএমইএ’র তালিকাভুক্ত। এর বাইরেও আরো কিছু ছোটখাটো কারখানা রয়েছে পরিদর্শনের বাইরে। ইউরোপীয় ক্রেতাদের উদ্যোগ অ্যাকর্ডের নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েজ বলছেন, “কারখানাগুলোকে সংস্কার কাজ শেষ করতেই হবে। যারা করবেনা তাদের কাছ থেকে পোশাক কেনা হবেনা। কোন কোন কারখানা মালিক একাজে পিছিয়ে আছে।কিন্তু আমরা আশা করছি তারা এটা শেষ করবে।”
রানাপ্লাজা ধ্বসের ঘটনা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে বিশ্ব দরবারে এক বড় প্রশ্নের মুখে দাড় করিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে এই শিল্প।কারণ নিরাপদ কর্ম পরিবেশ গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই।