ওয়াসার ৯ লুটেরা-বিল নয়ছয় করে কোটিপতি
লাবণ্য চৌধুরী : ঢাকা ওয়াসার ৯ লুটেরা আঙ্গুল ফুলে বটগাছে পরিণত হয়েছে। গ্রাহকের বিল নয়ছয় করেই এরা কোটিপতি। চলে নবাবী স্টাইলে। হাকায় দামি গাড়িও। ঘুষ, দুর্নীতি ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসার মিটার রিডার তালেবুল ইসলাম তালেব, নির্বাহী প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম, মিটার রিডার ওয়ারেস হোসেন মুন্সি, মিটার রিডার খায়রুল হাসান নিপু, পাম্প অপারেটর তাসাদ্দেক হোসেন অন্যতম প্রধান লুটেরা।
দুদকের তালিকায় রয়েছেন ঢাকা ওয়াসার মিটার রিডার তালেবুল ইসলাম তালেব, মিটার রিডার ওয়ারেস হোসেন মুন্সি, নির্বাহী প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম, মিটার রিডার খায়রুল হাসান নিপু, ওয়াসার পাম্প অপারেটর তাসাদ্দেক হোসেন, মিটার রিডার স ম আনোয়ার হোসেন, প্ল্যানিং সহকারীর (বর্তমানে উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা) ফারুক হোসেন, পাম্প অপারেটর আশকার ইবনে শায়েখ ও শিক্ষানবিশ পাম্প অপারেটর মো. মাসুদ হোসেন।
দুদক বলেছে, সংস্থাটির ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বাড়ি-গাড়িসহ কোটি কোটি টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে রয়েছে। তাদের এসব অবৈধ সম্পদের তথ্য এখন দুদকের কাছে রয়েছে। দুদকের সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াতের নেতৃত্বে একটি টিম এই ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের তথ্য পর্যালোচনা করছে। শিগগিরই কমিশনে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) মিটার রিডার মীর মো. তালেবুল ইসলাম তালেব। চতুর্থ শ্রেণির এ কর্মচারীর সব মিলিয়ে মাসিক বেতন প্রায় ২৪ হাজার টাকা। অথচ তার রয়েছে রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরায় তিনটি ফ্ল্যাট। যার বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।
তবে শুধু তালেব একাই নন, ঢাকা ওয়াসার এমন আরও অনেক কর্মী রয়েছেন যাদের বৈধ আয়ের চেয়ে অর্জিত সম্পদের পরিমাণ বহুগুণ বেশি। রাজধানী ঢাকায় তাদের কারও রয়েছে ছয়তলা, কারও আটতলা আবার কারওবা রয়েছে দশতলা বাড়ি। আবার যাদের বাড়ি নেই তাদের রয়েছে কোটি টাকা দামের একাধিক ফ্ল্যাট।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার এসব কর্মী অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি-গাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে মিটার রিডারদের কেউ কেউ বাণিজ্যিক বিলকে আবাসিক দেখিয়ে মালিকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া রিডিং কমবেশি দেখিয়ে উৎকোচ গ্রহণ করে থাকেন।
দুদক জানায়, ২০২৩ সালের জুনে ওয়াসার মিটার রিডার তালেবুল ইসলামসহ ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়ে কমিশনে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদকের সহকারী পরিচালক রাকিবুল হায়াতের নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করা হয়।
অনুসন্ধান টিম ২০২৩ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ওয়াসার ওই ৯ কর্মীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের রেকর্ডপত্র চেয়ে সরকারি-বেসরকারি তফসিলি ব্যাংক, বীমা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপারেশন, রেজিস্ট্রি অফিস ও ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে ওই ৯ কর্মী ও তাদের স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা প্লট, ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালান্সসহ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়। দুদকের চিঠি পেয়ে বিভিন্ন দপ্তর থেকে রেকর্ডপত্র পাঠানো হয়েছে দুদকে, যার এখন পর্যালোচনা চলছে।
দুদক জানায়,অভিযুক্তদের সম্পদের রেকর্ডপত্র দুদকের কাছে এসেছে। অনুসন্ধান কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে মিটার রিডাররা ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি-গাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে মিটার রিডারদের কেউ কেউ বাণিজ্যিক বিলকে আবাসিক দেখিয়ে মালিকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া রিডিং কমবেশি দেখিয়ে উৎকোচ গ্রহণ করে থাকেন। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তারা গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার মিটার রিডার তালেবুল ইসলাম তালেব চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। সব মিলিয়ে বেতন পান প্রায় ২৪ হাজার টাকা। অথচ তার রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরায় তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। তিনি ঢাকা ওয়াসার উত্তরার (রাজস্ব জোন-৯) মিটার রিডার। নিজ কর্মএলাকা উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১০/বি সড়কের ২৯ নম্বর ‘বন্ধন’ ভবনের ছয়তলায় তার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন। আর ১ হাজার ৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছেন। একই ভবনের দোতলায় ১ হাজার ৫০ বর্গফুটের আরেকটি ফ্ল্যাটও ভাড়া দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী ফখরুল ইসলাম অঢেল সম্পত্তির মালিক। রাজধানীর ঢাকা উদ্যানের ডি-ব্লকের ৩ নম্বর সড়কের ২৮ নম্বর প্লটে একটি ১০-তলা ভবন রয়েছে তার। ভবনটির প্রতিতলায় দুটি করে ফ্ল্যাট। শুধু ১০-তলায় সিঙ্গেল ইউনিট, সেখানে পরিবার নিয়ে থাকেন এই ওয়াসা কর্মকর্তা। এ ছাড়া তার ঢাকা উদ্যানের সি-ব্লকের ২ নম্বর রোডের ৩১ নম্বর প্লটে ১০-তলা আরেকটি বাড়ি নির্মাণাধীন। লালমাটিয়ার সি-ব্লকের ২/৮ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৫/এ নম্বর ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। নবীনগর হাউজিংয়ের ১ নম্বর রোডে একটি প্লটে টিনশেডের ঘর ভাড়া দিয়ে রেখেছেন তিনি।
যাত্রাবাড়ী এলাকার (জোন-১) মিটার রিডার ওয়ারেস হোসেন মুন্সি। তার পীরেরবাগের ৩২২/১ হোল্ডিংয়ে পাঁচ কাঠা জমিতে ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। বাড়ির ফটকের দুপাশে রহিমা জেনারেল স্টোর ও আল-আমিন স্যানিটারি নামে দুটি দোকান আছে। বাড়িটির দাম কয়েক কোটি টাকা। তিনি ৪০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাড়িটি করেছেন। বিল বেশি করার হুমকি দিয়ে বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে এ ওয়াসা কর্মীর বিরুদ্ধে।
ঢাকা ওয়াসার জোন-১০ (মিরপুর এলাকার) মিটার রিডার খায়রুল হাসান নিপু থাকেন রাজধানীর মিরপুরের আহম্মদনগরের ১৮৪ নম্বর বাড়িতে নিজের একটি ফ্ল্যাটে। এটির দাম ১ কোটি টাকার বেশি। তার ১৮৪/৩ এ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাড়িতে আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এটির দামও প্রায় ১ কোটি টাকা। এ ছাড়া আহম্মদনগর ১১৮/বি হোল্ডিংয়ের পাঁচ কাঠা জমিতে ২০টি টিনশেড রুম ভাড়া দেওয়া আছে। তার ৬০ ফুট সড়কে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে অফিস শেষে নিয়মিত বসেন। ব্যক্তিগত দামি গাড়িও রয়েছে নিপুর।
ঢাকা ওয়াসার পাম্প অপারেটর তাসাদ্দেক হোসেনের পূর্ব বাসাবোর ১৬/২/বি নম্বর প্লটে ছয় কাঠা জমিতে ‘মঙ্গলদ্বীপ’ নামে আটতলা একটি বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণগাঁও এলাকায় পাঁচ কাঠা জমিতে রয়েছে আরেকটি তিনতলা বাড়ি। তিনি ২০২৩ সালে অবসরে যান।
রাজস্ব জোন-৭ (যাত্রাবাড়ী এলাকা)-এর মিটার রিডার স ম আনোয়ার হোসেনের পশ্চিম পীরেরবাগের ৩২৭/৫/এ প্লটে একটি সাততলা বাড়ি রয়েছে। বাড়িটির নাম আফিয়া হাউজ। তিনি ২০২৩ সালের মাঝামঝি সময়ে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পান।
প্ল্যানিং সহকারীর মতো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে ঢাকা ওয়াসায় যোগদান করলেও ফারুক হোসেন বর্তমানে জোন-৯ (উত্তরা এলাকা)-এর উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা। তার মিরপুর পীরেরবাগের ৩২৭/৫ নম্বর প্লটে ছয় কাঠা জমির ওপর ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। এ বাড়িটির বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া তার সাভারে আরেকটি বাড়ি রয়েছে।
আশকার ইবনে শায়েখ ওয়াসার জোন-২ (লালবাগ চাঁদনীঘাট)-এর পাম্প অপারেটর। তিনি ঢাকা ওয়াসার শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের (২৫২২) সাধারণ সম্পাদক। রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকার মেরাজনগরে বি-ব্লকের ১৬৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে স্বজন বিলাস নামে একটি ভবনে তার ফ্ল্যাট রয়েছে। একই ভবনে ফ্ল্যাট রয়েছে আশকারের শ্যালক শিক্ষানবিশ পাম্প অপারেটর মো. মাসুদ হোসেনের। ভবনটির তৃতীয়তলায় থাকেন আশকার ইবনে শায়েখ এবং চারতলায় মাসুদ পরিবার নিয়ে থাকেন। আশকার ইবনে শায়েখসহ ওয়াসার কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে সংস্থাটির ৩৪৮ কোটি টাকার বেশি লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।