• বুধবার , ২০ নভেম্বর ২০২৪

‘ওয়ান্ডার’ লাকীর কারিশমা


প্রকাশিত: ৮:৩৮ পিএম, ২৫ জুন ২৪ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৯৬ বার

 

 


ছাগলকান্ড’র নায়িকা’র রহস্যজনক রাজনীতি-

 

লাবণ্য চৌধুরী : ছাগলকান্ড’র পরে প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়া লায়লা কানিজ লাকীর রহস্যজনক রাজনীতির মুখোশ উন্নোচিত হয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে সেই ‘ওয়ান্ডার’ লাকীর এতো কারিশমা কি করে সম্ভব হলো। কি করেই বা প্যান্ডোরার বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়ছে এত সম্পদ! মতিউর ছাড়া লাকীর আর কি কোনো গডফাদার আছে ! হাঁ আছে সে এক গডফাদার হচ্ছে! তবে তিনি কথা বলতে ‘রাজি’ হচ্ছেন না। মতিউরের অবৈধ টাকায় খেলেছে সেই রাজি। ফলে লাকী কে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

অথচ দুই বছর আগেও লায়লা কানিজ রায়পুরা উপজেলার রাজনীতিতে পরিচিত মুখ ছিলেন না। দলীয় পদ তো দূরের কথা, তিনি সাধারণ একজন কর্মীও ছিলেন না। স্থানীয় লোকজন তাঁকে জানতেন ‘ওয়ান্ডার পার্ক’ নামের একটি বিনোদনকেন্দ্রের মালিক হিসেবে। রাজনীতিতে ঢুকে এক বছরের ব্যবধানে তিনি হয়ে গেলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান, পেয়ে গেলেন জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদকের পদ।

ছাগল–কাণ্ডে আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ (লাকী) নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির তিনি ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। রাজনীতিতে লায়লা কানিজের বিস্ময়কর উত্থানের বিষয়ে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, সরকারি কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজের এলাকায় ‘ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট’ নামের একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলেন তিনি। এক দশক ধরে অল্প পরিসরে শুরু হওয়া পার্কটির আয়তন বর্তমানে দেড় একর। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়টাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজীউদ্দিন আহমেদ ওই পার্কে যাতায়াত শুরু করেন। তখনো লায়লা কানিজের দলীয় কোনো পদ নেই, এমনকি তিনি কর্মীও নন।

রাজীউদ্দিন আহমেদ দলীয় কর্মসূচি পালনের জন্য বেছে নিতেন ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টটি। ২০২২ সালের শেষ দিকে তিনি লায়লা কানিজকে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তখন তিনি ছিলেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক। ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর রায়পুরা উপজেলার তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুস সাদেক ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে পদটি শূন্য ঘোষণা করা হলে কলেজের চাকরি ছেড়ে লায়লা কানিজ হঠাৎ করেই রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেন। উপনির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন। এর ঠিক আগেই লায়লা কানিজকে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই উপনির্বাচনে লায়লা কানিজ ছাড়াও আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহসভাপতি শামসুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক ইমান উদ্দিন এবং উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য মনির হোসেন। কিন্তু সংসদ সদস্য রাজীউদ্দিন ও রাজস্ব কর্মকর্তা স্বামী মো. মতিউর রহমানের প্রভাবে দলীয় মনোনয়ন পান লায়লা কানিজ।

উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, স্বামী মতিউর রহমান অবৈধ অর্থ ছড়িয়ে লায়লা কানিজকে দলীয় মনোনয়ন এনে দিয়েছিলেন। দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় তিনিসহ আওয়ামী লীগের কোনো নেতা ওই উপনির্বাচনে অংশ নেননি। যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদেরও হুমকি–ধমকি দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। কোনো দলীয় পদ না থাকা লায়লা কানিজকে গুরুত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নিজেই এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

ওই উপনির্বাচনের পাঁচ প্রার্থীর একজন সোলাইমান খন্দকারের ভাষ্য, ওই উপনির্বাচনে সব স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ ছাড়া কয়েকজনকে দেখানো হয়েছিল বড় অঙ্কের টাকার প্রলোভন। কারা কারা হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁদের নাম বলে নতুন করে বিপদে পড়তে চান না তিনি। তাঁর ভাষায়, আমি প্রথমে ভয়ভীতিকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু যখন ছেলেমেয়েকে হুমকি দেওয়া শুরু করল, তখন বাধ্য হই। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার ১৫ মিনিট আগে আমি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছিলাম।

উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লায়লা কানিজকে একপ্রকার জোর করে স্থানীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করা হয়েছে। অবস্থা এখন এমন যে সংসদ সদস্য ও লায়লা কানিজ একটি পক্ষ আর সব আওয়ামী লীগ নেতা আরেক পক্ষ। সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় নরসিংদীর সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই তাঁর এই উত্থান।

এসব বিষয়ে জানতে লায়লা কানিজের ব্যবহৃত তিনটি মুঠোফোন নম্বরে কল করে বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, কল করে পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি তিনি এখন কোথায় আছেন, তা-ও কেউ বলতে পারছেন না।রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসাইন বলেন, লায়লা কানিজকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের খুব বড় ক্ষতি করে ফেলেছেন সংসদ সদস্য রাজীউদ্দীন আহমেদ।

আমাদের দলে কি আর কোনো নেতা নেই? তাঁকেই কেন রাজনীতিতে জোর করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে? এই লায়লা কানিজের জন্য এখন থেকে আমাদের অনেক মূল্য দিতে হবে। এসব সম্পর্কে সংসদ সদস্য রাজীউদ্দীন আহমেদের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি। পরে এসএমএস পাঠিয়ে ও হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম তালেব হোসেনের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরে কল দিয়ে তাঁকেও পাওয়া যায়নি।এদিকে উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ আজ মঙ্গলবারও তাঁর কার্যালয়ে যাননি। সেবাপ্রার্থীরা তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। ছাগল–কাণ্ডের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে আছেন তিনি। তিনি ঠিক কবে থেকে অফিস করবেন, তা–ও জানেন না উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তারা।উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান তাজ তাহমিনা মানিক বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর গত এক বছর লায়লা কানিজ কখনোই নিয়মিত অফিস করতেন না, মাঝেমধ্যে আসতেন। পরিষদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভায় তিনি উপস্থিত থাকতেন না। ঈদের পর থেকে তিনি অফিস করছেন না।