এসপি বাবুলের ‘ক্লু’ আছে ফকিরাপুলের ক্রিমিনাল মুছার কাছে
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : ‘ক্লু’ আছে কামরুল ইসলাম মুছা ওরফে মুছা সিকদারের কাছে। চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ‘ক্লু’ আছে মুছার কাছে।এজন্য তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
দুই আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার এ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে জবানবন্দিতে মুছার নাম উল্লেখ করেছেন। সিএমপির বাকলিয়া থানার ওসিসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করতেন। এছাড়া এই মুছা হচ্ছে ঢাকার ফকিরাপুল কেন্দ্রিক অপরাধচক্রের সহযোগী।
এমনকি কয়েকটি সূত্র বলছে, বাবুল আক্তারেরও ঘনিষ্ঠ সোর্স ছিলেন মুছা। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে মুছার নাম ঘুরেফিরে এলেও তার খোঁজ . মিলছে না। দীর্ঘদিন ধরে মুছার বাড়িঘরে ঝুলছে তালা। পরিবার থেকে জানানো হয়েছে, মিতু হত্যার পর ১২ জুন পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায়। মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুছা নামের কাউকে তারা এখনও গ্রেফতার করেননি।
মুছাকে নিয়ে এমন গোলকধাঁধায় গতি হারাচ্ছে মিতু হত্যার তদন্ত। পাশাপাশি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে, পুলিশ যদি আটক করেই থাকে তাহলে কোন ‘সত্য’ লুকানোর জন্য মুছাকে সামনে আনা হচ্ছে না। মুছা যদি গ্রেফতার না হন তাহলে জবানবন্দিতে নাম আসার পরও তাকে গ্রেফতার করতে কেন এখন পর্যন্ত কোনো অভিযানে নামেনি পুলিশ। এরই মধ্যে বুধবার মুছাসহ পাঁচজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেশের সব স্থল ও বিমানবন্দরে বার্তাও পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ।
দুই আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও কার পরিকল্পনায় মুছা খুনের নির্দেশ দিলেন তা স্পষ্ট হয়নি। কী কারণে মিতুকে খুন করা হলো তাও অজানা থেকে গেছে। মুছাকে পেলে গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। একটি সূত্র বলছে, মুছাসহ দু’জনকে ঢাকায় নিয়ে এসপি বাবুল আক্তারের মুখোমুখি করেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। সেখানেও রয়েছে রহস্য।
এখন ‘ধীরে চলো নীতি-
মিতু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এখন ‘ধীরে চলো নীতি’ গ্রহণ করেছে প্রশাসন। তাই হত্যায় অস্ত্র সরবরাহকারী এহতেশামুল হক ভোলা ও অস্ত্র গচ্ছিত রাখা মনিরকে গ্রেফতারের পরও সময়মতো আদালতে আনেননি মামলার সংশ্লিষ্টরা। সোমবার রাতে তাদের গ্রেফতার করা হলেও মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার মধ্যেও আদালতে আনা হয়নি। বিচারক এজলাস থেকে নেমে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পর দুই আসামিকে আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয়। তাদের দু’জনের জন্য পৃথকভাবে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জমা দিলে আদালত তা শুনানির সময় ঈদের পর নির্ধারণ করেন।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কৌসুলি বলেন, ‘বিচারক এজলাস থেকে নেমে যাওয়ার পর আসামি আনার অর্থই হচ্ছে এ মুহূর্তে রিমান্ড চাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। আবার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় আসামিদের আদালতে না এনেও তারা পারছিল না।’
মুছা কোথায়? :সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার চৌধুরী এর আগে বলেছিলেন, ‘মিতু হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের শনাক্ত করেছে পুলিশ। শিগগির এ হত্যার রহস্য উন্মোচন হবে।’ আনোয়ার ও ওয়াসিমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির দিন এমন মন্তব্য করেন তিনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডিবি, দক্ষিণ) মো. কামরুজ্জামান বলেছেন, ‘মুছা নামের কেউ এখনও আমাদের হাতে আটক কিংবা গ্রেফতার হয়নি। মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো পক্ষের হেফাজতে আছে কি-না সেটিও আমাদের জানা নেই।’ মুছাকে নিয়ে পুলিশ কমিশনার ও তদন্ত কর্মকর্তার এমন মন্তব্যও প্রশ্নবিদ্ধ করছে মামলাকে।
মুছার পরিবারের দাবি, ১২ জুন মুছাকে তার বাকলিয়ার কালামিয়া বাজারের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর থেকে তার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের কোনো যোগাযোগ নেই। তার গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের ঠাণ্ডাছড়ির মধ্যম ঘাগড়া গ্রামে। মুছার চাচাশ্বশুর ফারুক সিকদারের বরাত দিয়ে রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি জানান, মুছার পরিবারের কারও সঙ্গেই তাদের এখন আর যোগাযোগ নেই।
১২ জুন গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মুছার তিন ভাইকে আটক করে পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্য মতে বাকলিয়া থেকে আটক করা হয় মুছার স্ত্রী পান্না আক্তারকে। পরে মুছাকেও আটক করা হয়। কয়েকদিন আটক রাখার পর অন্যদের ছেড়ে দিলেও মুছা ও তার ভাই সাইদুল ইসলাম সিকদারকে এখনও তারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
ফারুক সিকদার আরও জানান, মুছার স্ত্রী ছাড়া পেলেও তিনি আত্মগোপনে আছেন। তাদের বাকলিয়ার বাসায়ও এখন কেউ থাকছেন না।
কে এই মুছা সিকদার :মুছা সিকদার রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের রানীরহাট এলাকার খোয়াইল্ল্যার পাড়ার মৃত শাহ আলম সিকদারের ছেলে। ৬ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তৃতীয় মুছা সিকদার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন মুছা। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে থেকে ২০০০ সালের শুরুর দিকে তিনি দেশে চলে আসেন। বিয়ে করেন আপন চাচা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কনস্টেবল ফারুক সিকদারের মেয়ে পান্না সিকদারকে।
২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির ক্যাডারদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন মুছা। মূলত প্রয়াত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হাত ধরেই তার উত্থান ঘটে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে উত্তর রাঙ্গুনিয়া এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন মুছা সিকদার ও তার সহযোগীরা।
এক সময় পুলিশ ও র্যাবের বিশ্বস্ত সোর্স হিসেবেও পরিচিত হতে থাকেন মুছা। ওয়ান-ইলেভেনের সময় সেনাবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ আটক হন তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান মুছা সিকদার ও তার সহযোগী জিল্লু ভাণ্ডারী। পরে মুছা সিকদার রাঙ্গুনিয়া ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরের কালামিয়া বাজার এলাকায় নিজের আস্তানা গড়ে তোলেন। এখানে এসে তিনি কক্সবাজারভিত্তিক ইয়াবা ও অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ঢাকা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, মিরপুর ও আরামবাগকেন্দ্রিক অপরাধ চক্রে মুছার নাম বিভিন্ন সময় উঠে এসেছিল।
পাঁচজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও নাম আসায় মুছাসহ পাঁচজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পুলিশ। অন্য চারজন হলেন_ রাশেদ, নবী, শাজাহান ও কালু। গত ৫ জুনের হত্যাকা ে তারা সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা। গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) পক্ষ থেকে এ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশের সব স্থল ও বিমানবন্দরে বার্তা পাঠানো হয়।সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, ‘এ পাঁচজন যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য স্থল ও বিমানবন্দরগুলোয় পুলিশের পক্ষ থেকে থেকে জানানো হয়েছে।’